জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক স্যারের মেধামনন এবং জ্ঞানগরিমা সম্পর্কে কমবেশি সবাই সুবিদিত। রাজ্জাক স্যারের প্রতি বুদ্ধিজীবী মহলের ব্যাপক কৌতূহল ও আগ্রহের সৃষ্টি হয় সত্তরের দশকের গোড়ায়, যখন দিল্লি থেকে প্রকাশিত স্বনামধন্য পত্রিকা ইলাস্ট্রেটেড উইকলি তাঁকে গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনিসের সঙ্গে তুলনা করে প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশ এবং এরপর ’৭৩-এ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় যখন তাঁকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান করে। তবে এর আগে এক প্রণিধানযোগ্য ও চমকপ্রদ বিষয় হলো- ভুবনখ্যাত ইংরেজ পণ্ডিত ডিক উইলসন তাঁর আলোচিত ‘এশিয়া অ্যাওয়েকস’ গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন তাঁর সুহৃদ আব্দুর রাজ্জাককে। উৎসর্গ বাক্যবন্ধটিতে ডিক লেখেন, ‘টু আব্দুর রাজ্জাক অব ঢাকা, হু ব্রট ইস্ট ইন মাই মাইন্ড’। বলা সংগত, এসবের প্রভাব তো দ্রুত সর্বত্র বিস্তৃত হয়েছেই, তার ওপর ’৭৫-এর জানুয়ারিতে মুজিব সরকার যখন তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক করে তাঁর মর্যাদা গৌরবান্বিত করে, তখন তিনি আকর্ষণের উচ্চমার্গীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়ে যান স্বাভাবিক কারণেই। ১৯৩৬ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ঢাবিতে তাঁর অধ্যাপনার কাল। ১৯৫৬ সালে তিনি সংবিধান খসড়া প্রস্তুতি কমিটিতে অংশ নেন, পরের বছর প্ল্যানিং কমিশনে, এরপর ১৯৫৯-৬০ সালে তিনি হার্ভার্ডে যোগ দেন ভিজিটিং ফেলো হিসেবে। অধ্যাপক রাজ্জাকের সনদ অনুযায়ী বয়স ’৭৪-এর ৩০ জুন ৬০ বছর পূর্ণ হওয়ায় অধ্যাপনা থেকে তাঁকে অবসরে যেতে হয়। দুঃখ ও দুর্ভাগ্যের বিষয় সহকারী অধ্যাপকই থেকে যান, পূর্ণ অধ্যাপক আর হতে পারেন না! বিদ্বেষ এবং বিভাজিত শিক্ষক রাজনীতির কারণে!
প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার কারণে তিনি এনএসএফের কোপানলেও পড়েন। তখন তিনি বেলিয়াল কলেজ, অক্সফোর্ডের আমন্ত্রণে দেড় বছর সেখানে (১০-০৯-৬৯ থেকে ০৩-০৭-৭০) ডকুমেন্টস এডিটিংয়ের কাজ করেন। লন্ডনে তিনি ডিপ্লোমা ইন লাইব্রেরিয়ানশিপও সমাপ্ত করেন একপর্যায়ে। এরপর সাড়ে পাঁচ বছর তিনি হার্ভার্ডে বিশ্বখ্যাত তাত্ত্বিক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক হ্যারল্ড জোসেফ লাস্কির সরাসরি তত্ত্বাবধানে
political parties in india বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা করেন। কিন্তু লাস্কির আকস্মিক প্রয়াণে (মাত্র ৫৭ বছর) তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষতিটা হয় মারাত্মক। লাস্কির স্থলে উপবিষ্ট হন মরিস জোন্স। কিন্তু তাঁর সঙ্গে মতদ্বৈধতা দেখা দেয় থিসিসের কাঠামো নিয়ে। ফলে একধরনের অসন্তুষ্ট ও নিরুদ্যম হয়ে অধ্যাপক রাজ্জাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। ফলে পিএইচডি ডিগ্রি তাঁর অপ্রাপ্তই রয়ে গেল। উল্লেখ্য অধ্যাপক লাস্কি তাঁর প্রিয় ছাত্র আব্দুর রাজ্জাকের মধ্যে নেহরুর ছায়া খুঁজে পেয়েছিলেন বলে মন্তব্য করেছিলেন, ‘মি. রাজ্জাক তুমি চেষ্টা করলে নেহরুর মতো হইতে পারবা।’
রাজ্জাক স্যারের প্রিয় শিক্ষক অমিয়কুমার দাশগুপ্ত ঢাকা ছেড়ে দিল্লিতে গিয়ে স্থায়ী হন। স্যার যখন পরবর্তী সময়ে দিল্লিতে তাঁর শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে যান, তা নিয়ে আনিসুজ্জামান স্যার লিখেছেন, আমরা কলকাতা থেকে সরাসরি দিল্লি গিয়েছিলাম। সেখানে নেমেই যাই রাজ্জাক সাহেবের শিক্ষক অমিতকুমার দাশগুপ্তের বাড়িতে। অধ্যাপক দাশগুপ্ত ও তাঁর স্ত্রী বাড়ির সামনের বারান্দায় আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। স্যার উভয়েরই পদধূলি নিলেন। অমিয়বাবু অশ্রুসজল চোখে স্যারকে বুকে জড়িয়ে, ধরলেন। ... প্রবাস থেকে স্বগৃহে পুত্রের প্রত্যাবর্তনে বাড়িতে যেমন সাড়া পড়ে যায়, সেই সন্ধ্যা ছিল তেমনই। আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের ঘনিষ্ঠজনদের, যাঁরা তাঁর সমকালের বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় জড়িত তাঁদের সবার ধারণা জন্মেছে তাঁর সঙ্গে আলাপে, যে তিনি এক জীবন্ত বিশ্ববিদ্যালয়। জ্ঞানের রাজ্যের এমন কোনো বিষয় নেই, যা রাজ্জাক স্যারের অজানা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, তাঁর স্মরণশক্তিও ছিল অসাধারণ। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, পৌরনীতি, শিল্পকলা, নন্দনতত্ত্ব, পৌরাণিক ধর্মতত্ত্ব- সব বিষয়েই তাঁর জানার আগ্রহ ও পরিধি ছিল প্রবল। এত বিস্তৃত জ্ঞানের অধিকারী হয়েও মানুষটা ছিলেন নিরহংকার। সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে অবাধে মিশে যাওয়ার বিরল গুণ ছিল তাঁর। আত্মভোলা মানুষ ছিলেন। অনাড়ম্বর জীবনযাপনই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। তাঁর প্রিয় ছাত্র আহমদ ছফার বরাতে জেনেছি, বিলাত থেকে ফিরে স্যার ট্রটস্কির বই- ‘থিয়োরি অব পার্মান্যান্ট রেভল্যুশন’ এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলার ব্রত’ বইটি তরজমায় মনোনিবেশ করে অনেক দূর এগিয়েছিলেন; কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত পূর্ণতা পায়নি নিজেরই হেঁয়ালিতে না আলস্যে, তা অজানাই রয়ে গেল! তবে তাঁর অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা : Bangladesh : state of the nation শীর্ষক মূল্যবান প্রবন্ধটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছে আগ্রহীদের সৌজন্যেই। এটাই পরম পাওয়া আমাদের।
লেখক : সাংবাদিক