গত ২১ নভেম্বর যথাযথ মর্যাদা এবং উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদ্যাপিত হয়েছে। সব সেনানিবাস, নৌঘাঁটি ও স্থাপনা এবং বিমানবাহিনী ঘাঁটির মসজিদগুলোতে দেশের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি, সশস্ত্র বাহিনীর উন্নতি ও অগ্রগতি এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সশস্ত্র বাহিনীর শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে ফজরের নামাজ শেষে বিশেষ মোনাজাতের মধ্য দিয়ে দিনের কর্মসূচি শুরু হয়। এ কর্মসূচি শেষ হয় সেনাকুঞ্জে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। সশস্ত্র বাহিনীর এ বার্ষিক আয়োজনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, সাবেক সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ অন্য সব দেশের রাষ্ট্রদূত যেভাবে বেগম জিয়ার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন, তা সত্যি অভূতপূর্ব। সশস্ত্র বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের স্ত্রীরাও বেগম জিয়াকে একনজর দেখার জন্য, তাঁর সঙ্গে কুশলবিনিময় করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে একান্তে কথা বলেন। তিনি তাঁর প্রতি আন্তরিক সম্মান প্রদর্শন করে শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন। প্রধান উপদেষ্টা বেগম জিয়ার সুস্থতা কামনা করেন। বেগম জিয়াও প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানান এবং তাঁর স্ত্রী আফরোজী ইউনূসের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন। জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানও বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অত্যন্ত বিনীতভাবে তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের সুস্থতার জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। চব্বিশ গণ অভ্যুত্থানের দুই নেতা নাহিদ ইসলাম ও মাহফুজ আলম আবেগাপ্লুত হয়ে বেগম জিয়ার কাছে দোয়া কামনা করেন। তিনিও তাদের জন্য দোয়া করেন এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অবদানের উল্লেখ করেন। তাদের ধন্যবাদ জানান। তিনি দুই ছাত্রপ্রতিনিধিসহ সবার জন্য দোয়া করেন। এ সময় তারা দুজনই যেন মাতৃস্নেহলাভে আপ্লুত ছিলেন।
সেনাকুঞ্জে সবাই বেগম খালেদা জিয়াকে জাতীয় মুরুব্বি বা অভিভাবকের আসনে স্থান দিয়েছেন। সশস্ত্র বাহিনীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান তাঁকে পেয়ে মহিমান্বিত হয়েছে। দেশের রাজনীতিতে এমন শিষ্টাচার জুলাই বিপ্লবের আগে দীর্ঘদিন দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বেগম জিয়ার হুইলচেয়ারের কাছে বসে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছেন। তাঁর স্বাস্থ্য ও পরিবারের অন্য সদস্যদের খোঁজখবর নেন। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরাও এমন অভাবনীয় সৌজন্য ও শিষ্টাচার অতীতে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক নেতাকে কখনো প্রদর্শন করেননি। বিদায়ের সময় তিন বাহিনী প্রধান বেগম জিয়ার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেন। গাড়িতে ওঠা পর্যন্ত তিনজনই সেখানে অবস্থান করেন। তাঁরা সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির স্ত্রী, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে বিদায় জানান। এ অনুষ্ঠানে আবারও প্রমাণিত হলো, বেগম খালেদা জিয়াই এখন দেশে জাতীয় ঐক্যের একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতীক। বর্তমান ক্রান্তিকালে একমাত্র তিনিই পারেন সব সমস্যার সমাধান করে জাতিকে এগিয়ে নিতে। একমাত্র তিনিই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। অবশ্য তিনি এখন অসুস্থাবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তাঁর সুস্থতার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে দোয়া চাওয়া হয়েছে।
আমরা এখন সংকট ও শঙ্কা মোকাবিলা করছি। অনেক কষ্টের মধ্যেও দেশবাসীর স্বস্তির বিষয় হলো আওয়ামী লীগমুক্ত বাংলাদেশ। একটি আপদ থেকে আমরা মুক্ত হলেও নানান আপদে আটকা পড়ে যাচ্ছি। বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন অনুষ্ঠান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হলেও অন্য নানান কাজে জড়িয়ে পড়ছে সরকার। স্বদেশি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত না করে বিদেশিদের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতি দিনদিন তলানিতে ঠেকছে। শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বেকারত্ব বাড়ছে। দেশি উদ্যোক্তা, শিল্পপতি, ব্যবসায়ীদের ওপর তৈরি করা হচ্ছে চতুর্মুখী চাপ। অনেক উদ্যোক্তা সরব-নীরব চাঁদাবাজির কারণে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এসব নিয়ে ভাবার আগ্রহ সরকারের খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা দিনের পর দিন চেষ্টা করেও ব্যাংক ঋণ পাচ্ছেন না, অথবা ঋণ পুনঃ তফসিল করতে পারছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সাক্ষাৎ লাভ করাও অনেক ব্যবসায়ীর জন্য ভাগ্যের ব্যাপার। অনেক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, গভর্নর দপ্তরের আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রের অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানের আমলাতন্ত্রকে হার মানাচ্ছে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা বিনিয়োগের সুযোগ না পেলেও অতি অল্প সময়ে বন্দরের সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে কোনো সাতপাঁচ ভাবতে হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল (এলসিটি) পিপিপি প্রকল্পে ৩০ বছরের কনসেশন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও এপিএম টার্মিনালস। গত ১৭ নভেম্বর এ বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া টার্মিনাল ড্যানিশ কোম্পানিকে এবং পানগাঁও টার্মিনাল পরিচালনায় সুইজারল্যান্ডের মেডলগের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। এ চুক্তিসহ দেশের সার্বিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। প্রশ্নগুলো হলো, এমন কী জরুরি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, যে কারণে বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের এখনই দিতে হবে? বন্দর বিদেশিদের কাছে দেওয়া ছাড়া আর কোনো দৃশ্যমান বিদেশি বিনিয়োগ এখনো দৃশ্যমান হলো না কেন? দেশি শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা সরকারের তেমন কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না কেন? একের পর এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে কেন? একটি মিথ্যা হত্যা মামলা থেকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন মুক্ত হলেন অথচ একই রকম মামলায় অন্য ব্যবসায়ীরা এখনো আসামি কেন? তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট জব্দ কেন?
এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বন্দর বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ২৪ নভেম্বর তিনি তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুকে বলেছেন, বন্দর ও এলডিসি বিষয় দেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকারের দ্বারা নির্ধারণ হওয়া উচিত। বন্দর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবেশদ্বার। সেখানে যা ঘটে তা লাখো মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে যে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্যের চেয়ে বেশি। সম্প্রতি বন্দরের বিষয়ে গৃহীত দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত সাধারণ সিদ্ধান্ত নয়। এগুলো জাতীয় সম্পদের ওপর কৌশলগত প্রতিশ্রুতি- এগুলোও একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার নিচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বেঁধে দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘কেউ বলছে না যে আমরা এলডিসি থেকে উত্তরণ চাই না; কিংবা বন্দর সংস্কার চাই না। যুক্তিটি আরও সহজ, আরও মৌলিক-একটি দেশের ভবিষ্যৎ এমন সরকারের দ্বারা নির্ধারিত হওয়া উচিত নয়, যাকে দেশ নির্বাচিত করেনি।’
এ চুক্তির বিরুদ্ধে বামজোট, বন্দর রক্ষা ও করিডরবিরোধী আন্দোলন এবং শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) পৃথক প্রতিবাদ কর্মসূচির মাধ্যমে বলেছে, দেশের সম্পদ চট্টগ্রাম বন্দর। তা বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার এখতিয়ার অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। জনমত উপেক্ষা করে গায়ের জোরে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সম্পদ নিয়ে যেভাবে ছিনিমিনি খেলছে, তা বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানের মতো রাজপথে নেমে তাদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা হবে। বন্দর চুক্তির বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। ২৫ নভেম্বর বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি ফাতেমা আনোয়ারের হাই কোর্ট বেঞ্চে চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে রুল শুনানি হয়। রিটকারীদের আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেছেন, এ সরকার জনগণের সরকার নয়। রাজনৈতিক দল সমর্থিত সরকার। তাই এ অন্তর্বর্তী সরকার চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে বিদেশিদের সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে পারে না। এ বিষয়ে ৪ ডিসেম্বর রায় ঘোষণা করবেন হাই কোর্ট।
বন্দর ব্যবস্থাপনা, গভীর সমুদ্রবন্দর, পার্বত্যাঞ্চল, তেল-গ্যাসসহ প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি বিদেশিদের অনেক দিনের বিশেষ আগ্রহ, লোভী নজর। বিগত সব সরকারের সময়ে নির্বাচনের আগে এ কথাগুলো জনগণ শুনেছে। প্রায় সবাই অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন, ক্ষমতায় না গেলেও দেশের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হবে না। অবশ্য বিগত কোনো সরকারই এ অতিসংবেদনশীল কাজটি করেনি। কিন্তু বর্তমান সরকার বিদেশিদের কাছে বন্দরের টার্মিনাল দেওয়ার চুক্তি করে ফেলেছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রটোকলে হওয়ায় সেই চুক্তি জনগণকে জানানো যাবে না বলেও বিডা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। বর্তমান সরকারের জনগণের কাছে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। ভোটের আগে জনগণের কাছে তাদের কোনো ধরনের জবাবদিহি করতে হবে না। সে কারণেই এমন কর্ম করার সাহস দেখিয়েছে। এ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকেই একাধিক পাসপোর্টধারী অথবা প্রবাসী। বলতে গেলে অনেকেই পরিযায়ী। তীব্র দেশপ্রেমের কারণে বিদেশের বিলাসী জীবনযাপন ত্যাগ করে দেশের জন্য কাজ করতে তাঁরা ছুটে এসেছেন বলে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে অনেকবার বলেছেন। তবে এটা নিশ্চিত দেশের কাজ শেষ করে তাঁরা আবার ফিরে যাবেন নিজের জায়গায়। তাঁদের এমন ত্যাগ দেশপ্রেম, নাকি বিশেষ কোনো অ্যাসাইনমেন্ট-তা জানা যাবে নির্বাচিত সরকারের সময়ে। এদিকে বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল ও বন্দরসম্পৃক্ত সংগঠনগুলো। কিন্তু কিছু দল তেমন উচ্চবাচ্য করছে না। চক্ষুলজ্জার কারণে মৃদুস্বরে যা বলছে, তা আবার বোঝা যাচ্ছে না। তাদের এমন আচরণে সন্দেহ বাড়ছে। তাদের এমন আচরণ কি তাহলে ভবিষ্যৎ ক্ষমতা পাওয়ার প্রতিশ্রুতির অংশ, নাকি অন্য কিছু? সে কারণেই বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার মতো লোকদেখানো দেশপ্রেম, মৃদু প্রতিবাদ, সততার মুখোশে অসৎ দেশবিরোধী কাজে যাদের আঁতাত থাকবে, আগামী নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সময় দেশপ্রেমিক সবাইকে তাদের ব্যাপারে সাবধানে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
manju209@yahoo.com