পূর্ব বাংলার বাঙালি প্রথম ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই গণভোটে বিজয় লাভের মাধ্যমে আসাম প্রদেশের সিলেট জেলাকে পূর্ব বাংলার অংশ করে নেয়। পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতি নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পায় ১৯৫৪ সালে। যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২২৩টিতে নিরঙ্কুশ বিজয় পেয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক সরকার গঠন করে। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৫৫ সালে সেই যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেয়। পরের ইতিহাস সবারই জানা। বহু সংগ্রাম আর ত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেও ক্ষমতায় বসতে দেওয়া হয়নি। বাঙালি সে অন্যায় মেনে নেয়নি। রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন করে বাঙালি জাতি ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। সুতরাং এ কথা বলাই বাহুল্য যে শান্তিপ্রিয় বাঙালি জাতির মননে নির্বাচনের একটা বিশাল প্রভাব রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশতাব্দী পার হলেও আমরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচনি ব্যবস্থা গড়ে তোলার বদলে অধিকাংশ নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছি। সংগত কারণেই ৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের পর আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন জাতীয় জীবনে অতীব গুরুত্ব বহন করে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস সে বিষয়টি স্মরণে রেখেই বলেছেন, এটি একটি বড় প্রয়াস। অভ্যুত্থান থেকে নির্বাচনের পথে যাত্রা। এটি হবে শান্তিপূর্ণ, উৎসবমুখর, আনন্দ ও মিলনের সময়।
মানুষ তাদের আশা ও আকাঙ্খা প্রকাশ করতে পারবে। শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখরভাবে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। উল্লেখ্য প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন বাহিনী প্রধান রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ কথা বলেন। সম্প্রতি সশস্ত্র বাহিনী দিবসের এক অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী নিয়োজিত রয়েছে। সামনে দেশ একটা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। সেই নির্বাচনে আমরা যথাযথভাবে সরকারকে সহযোগিতা করব। নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করব, যেন আমরা সুন্দর একটা নির্বাচন পেতে পারি। সেনাপ্রধান আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের দেখানো পথ অনুযায়ী দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
উল্লেখ্য নির্বাচনের আগে ও পরে ৯ দিনব্যাপী বিশেষ নিরাপত্তা অভিযানে মোট ১০ লাখেরও বেশি নিরাপত্তাকর্মী দায়িত্ব পালন করবেন।
এদিকে বাংলাদেশ পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বিপিএম বলেছেন, মানুষ নির্বাচনের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। কোনো সন্ত্রাসী বা অপশক্তি আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বানচাল করতে পারবে না। বিগত তিনটি নির্বাচনে পুলিশকে বিতর্কিত করা হয়েছে। পক্ষপাতিত্ব ও অন্যায় করতে বাধ্য করা হয়েছে। যে কারণে বিগত দিনের সব ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন করবে পুলিশ। এ কারণেই পুলিশের সব ইউনিটের সদস্যদের প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে।
এদিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ২০ নভেম্বর ২০২৫, এক্স ফোর্সেস অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা বলেন, ‘সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরাপদ ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে সশস্ত্র বাহিনীর সক্রিয় ও নিরপেক্ষ ভূমিকা অত্যাবশ্যক। সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা, পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বিত নিরাপত্তাব্যবস্থার মাধ্যমে নির্বাচনে ভোট কারচুপি ও সহিংসতা প্রতিরোধ সম্ভব।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, নির্বাচন সফল করার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা বড়। দলগুলো আন্তরিকভাবে কাজ করলে নির্বাচন কমিশনকে বাড়তি চাপ নিতে হয় না। গত ১০-১৫ বছরে ভোটারদের মধ্যে একধরনের ভোটবিমুখতা সৃষ্টি হয়েছিল।
তাই ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক দল, দেশের ভোটার, নির্বাচন কমিশন এবং আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সবাই মিলে কীভাবে আমরা একটা সুন্দর নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারি- সেই লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করতে হবে সব পক্ষকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতেই হয়, আমাদের কিছুতেই ভুলে গেলে চলবে না বাঙালি জাতি ভোটের অধিকার রক্ষা ও আদায়ে জীবন দিতেও পিছপা হয় না। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সংগত কারণেই জনগণের প্রত্যাশা ড. ইউনূস ‘ইতিহাসের সেরা’ একটি স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন জাতিকে উপহার দিয়ে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন। দেশবাসীর মতো আন্তর্জাতিক মহলেরও এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী