আন্দরকিল্লা... লালদীঘি... কোতোয়ালি... নিউমার্কেট... সামনে আয়েন। মার্কেট... মার্কেট...।
হেলপারের চিল্লাপাল্লা, গাড়ির হর্ন আর হকার মিলে চকবাজার মোড়কে দোজখ বানিয়ে ছেড়েছে। নানা পদের বাহন, নানা রঙের মানুষ। নিউমার্কেটগামী বাসে চেপে বসি। জানালার পাশে সিট পেয়ে বেশ আরাম বোধ হয় আমার। ঘুষখোর, ইমানদার, বড় চাকুরে, মাছিমারা কেরানি, খুচরো ব্যবসায়ী, উঠতি রাজনীতিক... শত পদের যাত্রীতে গমগম করছে সিটি বাসের শরীর। পেট তার ডিমওয়ালা তেলাপিয়ার মতো হলেও মন ভরে না হেলপার-ড্রাইভারের। সমানে চিল্লাচ্ছে হেলপারটি... আয়েন... আন্দরকিল্লা... মার্কেট...। বাসের ভেতর থেকে এক হাতে ব্যাগ, আরেক হাতে বাসের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি চেঁচিয়ে ওঠেন, তোদের কি কুলায় না? মানুষের অফিস আছে তো...! তাকে সমর্থন দিয়ে হল্লা করে ওঠে কতিপয় যাত্রী। ড্রাইভার গতি দেয় গাড়িতে।
আন্দরকিল্লার যাত্রী নামেন... আগে নামতে দেন ভাই...। কোতোয়ালি... মার্কেট... আবারও ক্যানভাসজুড়ে দেয় হেলপার। এত যাত্রী তবুও শোকর নেই। এদের ধনীর পুলের ভাগাড়ে ফেলা দরকার। ওহ, ধনীর পুল? আমিও বুঝি না, চকবাজারের মতো জায়গায় অমন ময়লার স্তূপ হয় কীভাবে? নামের বাহার দেখ না, ধনীর পুল! নামে ধনী, কামে ছোটলোক। ইচ্ছা হলেও অতৃপ্ত হেলপারকে এর সঙ্গে তুলনা করা শোভন হবে না। যাত্রাবেলায় যারাই আসে ধনীর পুল হয়ে, নাক চেপে ধরতে হয় সুগন্ধি রুমাল কি টিস্যুতে। এই দুঃসহ ঘ্রাণের এমনই গুণ, সারা দিন নাকে দিয়ে যাবে গুপ্ত পীড়ন, মুখে থুথু। আমাকে যেতে হবে ফলমন্ডি। বেহানবেলার কাস্টমার ধরতে না পারলে বেচাকেনায় বরকত হয় না।
আন্দরকিল্লা ক্রস করে গাড়ি তখনো খুঁজে পায়নি বকশিবিটের নাগাল। দাঁড়িয়ে থাকা এক যাত্রী চিক্কুর পারে, আমার মোবাইল, আমার মোবাইল! যুবকের হাহাকারের সাথে আমার স্মৃতিও যেন মিলমিশ খেয়ে বসে আছে! বেচারা এ-র ও-র দিকে তাকায়, নিজের পকেটে বারবার হাতড়ায়। যাত্রীদেরই একজন বলেন, নাম্বার কন ভাই, কল দিয়ে দেখি...। সংযোগ পায় না। মুরব্বিগোছের এক যাত্রী খিস্তি কাটেন, কামের লোক কি এতক্ষণ বসে থাকে? নানা রকম সান্ত্বনায় বাসটি যেনবা মানবিক ভূখণ্ড।
পুরোনো না-হওয়া নিউমার্কেট চাক্ষুষে আসতেই হেলপারের গলা সপ্তমে। নামেন...। মার্কেট লাস্ট, নামেন... তখনো ঢের বাকি স্টেশনের। গন্তব্যের চাঞ্চল্যে হয়তোবা জোর চলে আসে যাত্রীদের পায়ে। হেলপারের তাড়া ফিরতি ট্রিপ ধরার। আগে মহিলাদের নামতে দেন...। এই মামা, বাম পা আগে দিয়ে নামেন...। মার্কেট লাস্ট...। সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি নামার। তখনো প্যাসেজে ভিড়, কী তাড়ারে বাবা সবার! পেছনের যাত্রীরা পারে তো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় সামনের যাত্রীদের। আমার অনতিদূরের তাগড়া জোয়ানটি তার সামনের যাত্রীকে লক্ষ্য করে অসহিষ্ণু গলায় বলে, আরে মিয়া এত টাইম লাগলে প্রাইভেট গাড়িতে উঠতে পারেন না; চাকরি আছে তো আমাদের! আরে নামেন, বাম পা আগে দিয়ে নামেন...। সর্বশেষ নামা যাত্রীটি হয়ে আমি নিউমার্কেট স্টেশনে দাঁড়িয়ে খেয়াল করি, যুবকের কথার তোড়ে কোনোরকমে নেমে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের বাম পা-টিই নেই!