সদ্য সমাপ্ত নিউইয়র্ক নির্বাচনে অভিবাসী মুসলিম প্রার্থী জোহরান মামদানীকে নিবার্চনে ব্যাপক বৈরিতা, তুমুল প্রতিরোধ ও দেশ থেকে বিতাড়নের হুমকি মাথায় নিয়ে এগুতে হয়েছে, নির্বাচনে প্রধান সম্বল ছিল তার আকর্ষণীয়, বিনয়ী ও যুক্তিপূর্ণ বাগ্মীতা এবং মানুষকে কাছে টানতে পারার কৌশল।
“নীতিতে অটল” থাকার গুণ ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বেশিরভাগ তরুণদের ধর্মাধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মামদানীর প্রতি আকৃষ্ট করেছিল এবং এই তরুণরাই সবাইকে একত্রিত করে বিজয় এনেছে। নির্বাচন পরবর্তী প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোটারের পাশাপাশি প্রায় ৩৩ ভাগ ইহুদিও মামদানীকে ভোট দিয়েছেন তার কর্মসূচিতে আকৃষ্ট হয়ে।
সাত বছর বয়সে উগান্ডা থেকে মা—বাবার সাথে আমেরিকায় আসেন মামদানী এবং লেখাপড়া শেষে থিতু হন নিউইয়র্কে। ছাত্রজীবন থেকে মানবিক সেবায় যুক্ত হন। আমেরিকার নাগরিকত্ব অর্জন করেন ২০১৮ সালে এবং এর দু বছরের মাথায় ২০২০ সালে নিউইয়র্কের স্টেট এ্যাসেম্বলী নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন এবং এর পাঁচ বছর পর অর্থাৎ নাগরিকত্ব পাওয়ার মাত্র সাত বছরের মাথায় তিনি নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হন, অসাধারণ এই রাজনৈতিক উত্থান ।
প্রথম মুসলিম মেয়র হিসেবে নিউইয়র্কের দায়িত্ব নিতে যাওয়া মামদানীর নির্বাচনী কার্যক্রম ছিল বিস্ময়কর যা তাকে বিজয় এনে দিয়েছে। নির্বাচনের দিন ৪ঠা নভেম্বর ফলাফল ঘোষণার দু’ঘন্টা পর রাত ১১ টায় বিজয়ী ভাষণে সেলিব্রেশন ভ্যানুতে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ ও বিশ্বের প্রায় তাবৎ প্রথম সারির মিডিয়ার সামনে দৃঢ় কণ্ঠে মামদানী তার পরিচয় পূর্ণব্যক্ত করেন “আমি মুসলমান” এবং “আমি একজন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী”।
তিনি তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও পূনর্ব্যক্ত করেন,“নিউইয়র্ক অভিবাসীদের শহরই থাকবে, অভিবাসীদের দ্বারা নির্মিত, অভিবাসীদের দ্বারা পরিচালিত এবং আজ রাত থেকে একজন অভিবাসীর নেতৃত্বে পরিচালিত”।
বিজয়ী ভাষণে অভিবাসন বিরোধী অভিযান সম্পর্কে দেশের প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ্য করে মামদানী বলেন, “মি. প্রেসিডেন্ট, “আমাদের কারো কাছে পৌঁছানোর জন্য, আপনাকে আমাদের সকলের মধ্য দিয়ে যেতে হবে’’।
গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় মামদানী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় গ্রুপ ও মানুষের কাছে গেছেন এবং কোনরকম রাখঢাক ছাড়া তার ধর্ম পরিচয় ও নীতি আদর্শ পরিস্কারভাবে ব্যক্ত করেছেন।
নিউইয়র্ক শহরের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৮৫ লক্ষ, এবারের নির্বাচনে রেজিস্টার ভোটার সংখ্যা ছিল ৫১ লক্ষ ৩ হাজার ৯৪১ জন। ভোট প্রয়োগ করেন ২০ লক্ষ ৩৭ হাজার ১৮৩ জন ভোটার, যা মোট ভোটারের ৩৯.৯১ ভাগ এবং গত নির্বাচনের চেয়ে ১৬.৫২ ভাগ বেশি । বলা হচ্ছে নির্বাচনী প্রচারণা এবং সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারার কারণে এবারের নির্বাচনে গত নির্বাচনের তুলনায় অনেক বেশি ভোটার ভোটদান করেছেন।
নির্বাচনী প্রচারণায় মামদানি ক্যাম্পেইনের কার্যক্রম ছিল দারুণ। তাদের দেয়া তথ্য মতে, ৫১ লক্ষ ভোটারের জন্য ১ লক্ষ ৪ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে তারা যুক্ত করেছিল যারা ভোটারদের কাছে ৪৫ লক্ষ বার কল করেছেন এবং ভোটের দিন সকাল পর্যন্ত ৩০ লক্ষতম ভোটারের দরজায় কড়া নেড়েছেন।
এই পরিশ্রমের ফসল হিসেবে মামদানি পেয়েছেন ১০ লক্ষ ৩৬ হাজার ৫১ ভোট, যা প্রদত্ত ভোটের ৫০.০৪ ভাগ এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তুখোড় রাজনীতিবিদ নিউইয়র্কের প্রাক্তন গভর্নর কোমোর চেয়ে ১ লক্ষ ৮১ হাজার ৫৬ ভোট বেশি। এভাবেই নির্বাচিত হন তরুণ মামদানী।
এই নির্বাচন যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশ ও মানুষের জন্য উদাহরণ হতে পারে, যেখানে সবাইকে সম্পৃক্ত করে সবার দুয়ারে পৌঁছে ভোট চাওয়া হয়েছে এবং অত্যন্ত পরিস্কারভাবে সাধারণ বাসিন্দাদের দৈনন্দিন চাহিদাগুলোকে ফলাও করে সামনে আনা হয়েছে ।
মামদানীর নির্বাচন এবং তার ব্যক্তিগত বিনয়ী ও দৃঢ় রাজনৈতিক দর্শন নেতৃত্ব গ্রহণ করতে আগ্রহী আমাদের প্রবাসী এমনকি নিবাসী তরুণদের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয় হতে পারে। দেশের প্রেসিডেন্টের সক্রিয় বিরোধিতার পরও মাথা উঁচু করে মামদানী নির্বাচিত হয়েছেন এবং নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে হোয়াইট হাউসে গেছেন তাও মাথা উঁচু করেই তার জনগণের স্বার্থ মাথায় রেখে।
প্রেসিডেন্টের সাথে অনুষ্ঠিত মামদানীর মিটিংয়ের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিজের নীতি—আদর্শের সাথে আপোষ না করেই মামদানী তার বিরোধীতাকারী প্রেসিডেন্টকেও জয় করে এসেছেন, কারণ প্রেসিডেন্ট বিভিন্ন বিষয়ে মামদানীর ব্যাখ্যায় একমত হয়েছেন এবং মামদানীর সফলতা কামনা করেছেন। সবশেষে মেয়র মামদানী ও নিউইয়র্কের প্রতি প্রেসিডেন্ট তার সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
১৬০৯ সালে ইংরেজ নাবিক হেনরি হাডসন কর্তৃক আবিষ্কৃত এবং ১৬২৪ থেকে ১৬৬৪ পর্যন্ত ডাচ এবং ১৬৬৫ থেকে ১৭৮৩ পর্যন্ত ইংরেজদের দ্বারা শাসিত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শহর নিউইয়র্ক শাসনের দায়িত্ব ১৭৮৪ সাল থেকে আমেরিকানদের হাতে আসে।
সব মিলিয়ে ৪০০ বছরের বেশী শাসনকালে কোন মুসলমান এই শহরটির নেতৃত্বে আসতে পারেনি। যে কারণে মামদানীর নির্বাচন বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করে।
২০২৬ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে প্রথমবারের মত নিউইয়র্ক শহরের দায়িত্ব অর্পিত হচ্ছে ৩৫ বছরের তরুণ একজন অভিবাসী মুসলমানের উপর। যা বিশ্বব্যাপী অভিবাসী বিশেষ করে মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক আশাবাদ তৈরি করেছে।
নিউইয়র্কারদের কাছে প্রদত্ত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিভিন্ন জাতি-ধর্মের বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্বের প্রাচীন এবং বর্তমান বিশ্বের আধুনিক ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক শহর নিউইয়র্কের সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধি কতটা বিকশিত হবে মামদানীর আমলে তার দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা পক্ষ-বিপক্ষের অগণিত মানুষ।
মামদানী তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন করতে পারেন তার সাথে জড়িয়ে আছে নবীন রাজনৈতিক মামদানীর নিজস্ব পরীক্ষা এবং সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে উঠে আসা পরবর্তী অভিবাসী প্রজন্মের নেতৃত্ব লাভের চ্যালেঞ্জ।
বিডি প্রতিদিন/কামাল