নন্দলাল কবিতাটি সম্ভবত আমার বয়সি অনেকেই স্কুলজীবনেই পড়ে থাকবেন। কবিতাটা হলো- নন্দলাল তো একদা কী একটা করিল ভীষণ পণ-/স্বদেশের তরে, যা করেই হোক, রাখিবেই সে জীবন। সকলে বলিল, আ-হা-হা কর কী কর কী নন্দলাল?/নন্দ বলিল, বসিয়া বসিয়া রহিব কি চিরকাল?/আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ?/তখন সকলে বলিল- বাহবা বাহবা বাহবা বেশ।/ছয় দশক পরও জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় দেশের শাসকদের হালহকিকত দেখে কেন যেন মনে হচ্ছে নন্দলাল আজও প্রাসঙ্গিক। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার শুধু জনগণকে নির্বাচন দিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না। গত ১৫ মাসে তারা সংস্কারের নামে অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে। নির্বাচনের আড়াই মাস আগে দেশের বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। যে করেই হোক এটি সম্পন্ন করাকে তারা কর্তব্য বলে ভাবছে।
সবারই জানা, জুলাই গণ অভ্যুত্থানের ফসল হিসেবে ক্ষমতায় আসে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করাকে এ সরকার দায়িত্ব হিসেবে নেবে এমনটিই আশা করেছে দেশের মানুষ। কিন্তু দেখে শুনে মনে হচ্ছে, আমাদের মহাদরদি সরকার নির্বাচনের আয়োজন শুধু নয়, সবকিছুতেই মাথা ঘামাচ্ছে। মহাদেশপ্রেমিক এই সরকার যেভাবেই হোক দেশের বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়াকে কর্তব্য বলে ভাবছে। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের আগেই পতিত সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল, বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তির কাছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ তুলে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
বিদেশিদের হাতে বন্দর তুলে দেওয়াকে অনেকে একই নাটকের অংশ হিসেবে ভাবছে। বিদেশিদের হাতে বন্দর তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো দেরিতে হলেও প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের এহেন পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন। তাঁর বক্তব্যের মোদ্দাকথা, কেউ বলছে না আমরা বন্দর সংস্কার চাই না। তবে বন্দরের বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত কোনো সাধারণ বিষয় নয়। এটি নির্বাচিত সরকারের দ্বারা নির্ধারিত হওয়া উচিত। চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবেশদ্বার। সেখানে যা ঘটে তা যে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্যের চেয়ে লাখো মানুষের জীবনে বেশি প্রভাব ফেলে। একটি অনির্বাচিত সরকার জাতীয় সম্পদের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বেঁধে দিচ্ছে। এর আগে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার সরকারের এ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারীরাও অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, ‘বন্দর রক্ষা ও করিডরবিরোধী আন্দোলন, চট্টগ্রাম’ নামের সংগঠন। তারা বলেছেন, দেশের বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার এখতিয়ার সরকারের নেই। চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া চর ও কেরানীগঞ্জের পানগাঁও টার্মিনাল চুক্তি বাতিল এবং নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের ইজারা প্রক্রিয়া বন্ধের দাবিতে চট্টগ্রামে মশাল মিছিল ও সমাবেশ করেছে সংগঠনটি। শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ বন্দর রক্ষার দাবিতে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সাফ সাফ বলেছে, দেশের সম্পদ চট্টগ্রাম বন্দর, তা বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার এখতিয়ার অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। জনমত উপেক্ষা করে গায়ের জোরে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সম্পদ নিয়ে যেভাবে ছিনিমিনি খেলছে, তা বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানের মতো রাজপথে নেমে ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা হবে।
দেশের অর্থনীতির স্বার্থে সামুদ্রিক বন্দরগুলোর অব্যবস্থাপনা দূর তথা সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু মাথাব্যথার জন্য ওষুধের বদলে মাথা কেটে ফেলা কোনো সমাধান হতে পারে না। সার্কভুক্ত দুটি দেশ শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান তাদের বন্দর চীনের হাতে তুলে দিয়ে যে সংকটে পড়েছে, তা মোটেও সুখকর নয়। শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পেছনে হাম্বানটোটো বন্দর তৈরিতে অর্থ অপচয় ও তা চীনের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনা অন্যতম ভুল ছিল। এ ভুল সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে ভারতের সঙ্গে তাদের যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, যা কোনো কল্যাণ বয়ে আনেনি।
পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গোয়াদর বন্দর চীনের হাতে তুলে দিয়ে একই বিপদে পড়তে হয়েছে। এর ফলে বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হয়েছে। আমেরিকাও গোয়াদর বন্দরে চীনের নিয়ন্ত্রণকে খারাপ চোখে দেখছে। ইরানের চাবাহার বন্দর পরিচালনার ভার দেওয়া হয়েছিল একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে। সেই প্রতিষ্ঠানকে হাত করে ইসরায়েল ইরানের অভ্যন্তরে তাদের ঘাঁটি গাড়তে পেরেছিল। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে তাদের এক ডজনের বেশি শীর্ষ জেনারেলকে প্রাণ হারাতে হয়েছে সে ভুলের কারণে।
ইরান ইসরায়েল যুদ্ধের সময় গত ২৫ জুন বাংলাদেশ প্রতিদিনের স্পষ্টভাষণ কলামে লিখেছিলাম, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামরিক শক্তিতে ইরান সমীহ অর্জনের কৃতিত্ব দেখিয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রক্সি যুদ্ধে মস্কোকে ড্রোনসহ অস্ত্রশস্ত্রের জন্য হাত পাততে হয়েছে ইরানের কাছে। আমেরিকার ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে তেহরান মস্কোর পাশে দাঁড়িয়েছে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে। যে দেশ রাশিয়াকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার যোগ্যতা রাখে, তাদের সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ১৩ জুন ইরানের ওপর নিখুঁতভাবে হামলা চালিয়ে ইসরায়েল যে ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছে, তা আধুনিক দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল। ইরানের সেনাপ্রধানসহ শীর্ষ জেনারেলদের হত্যার কৃতিত্ব দেখিয়েছে ইসরায়েল তার বিশ্বসেরা গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে। এক ডজনের বেশি সেরা পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়েছে একই কৌশলে।...
১৩ জুন ২০২৫ ইরানের ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে কালোদিন হিসেবে। শুক্রবার মুসলমানদের জুমার দিন। সাপ্তাহিক ঈদের দিন। এই দিনটিকে ইরানের জন্য কালোদিন বানানোর কৃতিত্ব ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের। বলা হচ্ছে, ইরানকে ঘায়েল করার যুদ্ধে মোসাদ পেয়েছে সে দেশের চাবাহার বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব পালনকারী ভারতীয় কোম্পানির সহায়তা। বলা হচ্ছে, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মনিরকেও ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহারের কৃতিত্ব দেখিয়েছে সিআইএর এজেন্টরা। ইরানের সেনাপ্রধানকে যুদ্ধের কয়েক দিন আগে একটি ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন পাকিস্তানি সেনাপ্রধান আসিম মনির। যে ঘড়িতে ছিল এমন ডিভাইস, যা ইরানি সেনাপ্রধানের ওপর নজরদারিতে ব্যবহৃত হয়। নিখুঁতভাবে সেনাপ্রধানের বাসভবনে ঠিক যে বিছানায় তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন, সেখানে হামলা চালানো সম্ভব হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে যে আরব দেশকে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের রেকর্ড মোটেও ভালো নয়। ইয়েমেন ধ্বংস হতে চলেছে ওই দেশটির কলকাঠি নাড়ার কারণে। আফ্রিকার বৃহত্তম দেশ সুদানে সামরিক বাহিনী ও এলিট বাহিনীর মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে, তার এক পক্ষে আছে ওই আরব দেশটির মদত। যাদের উদ্দেশ্য সুদানের বিশাল সোনার খনির মালিক হওয়া। বাংলাদেশে যাতে তেমন কিছু না ঘটে, চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব তাদের হাতে সমর্পণের আগে ভাবতে হবে।
বিড়াল ও আফগান নারী
যদি প্রশ্ন করা হয়, পৃথিবীর কোন দেশের নারীরা মানবাধিকারের দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে? এ প্রশ্নের জবাবে অনেকেই বলবেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ আফগানিস্তানের কথা। এটি এমন একটি দেশ, যেখানে বোরকা ছাড়া কোনো নারীর পক্ষে ঘরের বাইরে আসা কল্পনা করাও কঠিন। বাইরে বের হতে হলে সঙ্গে থাকতে হবে স্বামী, বাবা, ভাই, সন্তান ইত্যাদি সম্পর্কের পুরুষ আত্মীয়। নতুবা তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। আফগানিস্তানে মেয়েরা পড়াশোনা করতে পারে বড় জোর ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। ৯ বছর বয়সেই তাদের বিয়ের যোগ্য ভাবা হয়। চাকরির কোনো অধিকার নেই মেয়েদের।
এহেন আফগানিস্তান একসময় ছিল নারী অধিকারের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ। সে দেশের নারীরা ভোটাধিকার পায় ১৯১৯ সালে। আজ থেকে ১০৬ বছর আগে। সে সময় ভোটাধিকারের দিক থেকে ইউরোপের অনেক দেশের কাছেও আফগান নারীরাও ছিল ঈর্ষার পাত্র। দুনিয়ার সবচেয়ে অগ্রসর দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা ভোটাধিকার পায় ১৯২০ সালে। আফগানিস্তানে ১৯২০ সাল থেকে মেয়েরা স্কুলে যাওয়া শুরু করে। কাবুলিওয়ালাদের দেশে সে সময় বাল্যবিয়ে ছিল নিষিদ্ধ। বাংলাদেশে একসময় খাতাকলমে মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ছিল ১৬। এখন সর্বনিম্ন বয়স ১৮। তবে বাস্তবতা হলো আইন যা-ই হোক এখনো এ দেশে লাখ লাখ মেয়ের বিয়ে হয় শিশু বয়সে। অথচ আফগানিস্তানে ১৯৭০ সালে মেয়েদের সর্বনিম্ন বিয়ের বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ করা হয়। শিক্ষা ছিল বাধ্যতামূলক। শুধু ছেলেদের জন্য নয়, মেয়েদের জন্যও। আফগানিস্তানে আইন করে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়। সর্বস্তরে ছিল সহশিক্ষার সুযোগ। প্রাথমিক, মাধ্যমিক শুধু নয়, কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা একই ক্লাসরুমে বসে পড়ালেখা করতে পারতেন আজ থেকে ৬০ বছর আগেও। আফগানিস্তানে এখন ধর্মীয় শাসন। ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত সে দেশের মানুষ। নারীদের ভোটাধিকারের প্রশ্ন তো ওঠে না। অথচ আমেরিকার নারীরা প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার পান আফগান নারীদের ভোটাধিকার পাওয়ার এক বছর পর! একই সুযোগের জন্য ফ্রান্সের নারীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও ২৫ বছর। ১৯৪৪ সালে ফরাসি নারীরা ভোটাধিকার পান। আর ভারতবর্ষের নারীরা ১৯৫০ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতার দুই বছর পর প্রথম পেয়েছেন ভোটদানের সুযোগ।
আফগানিস্তানের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে খ্যাতিমান আমেরিকান অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপ বলেছেন, নিউইয়র্কে তিনি যখন কলেজ পাস করলেন, সেই বছর, সেই ১৯৭১ সালে সুইজারল্যান্ডের নারীরা প্রথম ভোটাধিকার পান। তার অর্ধসেঞ্চুরি বা ৫০ বছরে আগে ১৯১৯ সালে আফগান নারীদের সেই অধিকার ছিল। ১৯৭১ সালে সুইস নারীরা শুধু একটি গণভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। সে দেশের নারীরা সার্বিক বিবেচনায় ভোটাধিকার পান ১৯৯০ সালে।
মেরিল স্ট্রিপের অভিমত, সত্তর দশকে আফগানিস্তানে সরকারি কর্মকর্তা থেকে চিকিৎসক, শিক্ষক, আরও নানান পেশায় নারীরা ছিলেন আধাআধি। এখন সে অবস্থা উল্টে গেছে। এখন একটি বিড়ালও একজন আফগান নারীর চেয়ে বেশি স্বাধীন।
-মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
লেখক : সিনিয়র সহকারী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ