পুতিনের নেতৃত্বাধীন রাশিয়া অতীতের সোভিয়েত যুগের মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রভাববলয় গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি মার্কিন হামলার মুখে ইরান ও ভেনেজুয়েলায় বিপুল সামরিক সহায়তা, কোনো রকমের ঘোষণা ছাড়াই সিরিয়ায় রুশ এলিট ফোর্স প্রেরণ, মাদাগাস্কারের নতুন সরকারের প্রতি রুশ সমর্থন ও ভাড়াটে সেনা প্রেরণ তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ। এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফ্রিকায় ফরাসি ও মার্কিন আধিপত্যকে পেছনে ফেলে রাশিয়া সুস্পষ্ট আধিপত্য বিস্তার করেছে। বিশেষ করে পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে।
সাহেল অঞ্চলের তিনটি দেশ- বুরকিনা ফাসো, মালি ও নাইজার ফরাসি ও মার্কিন সেনাঘাঁটি বন্ধ করে ওই দুই দেশের সেনাদের বহিষ্কার করার পর তাৎক্ষণিকভাবে রাশিয়া ওই শূন্যস্থান পূরণ করে। ওই দেশগুলোতে রাশিয়া তার সেনাবাহিনী প্রেরণ বা ঘাঁটি স্থাপন না করলেও ওই দেশে প্যারামিলিশিয়া ও ভাড়াটে সেনা ওয়াগনার গ্রুপকে প্রেরণ করেছে। ২০২৪ সালের ২ মে নাইজারের রাজধানী নিয়ামির অদূরে একটি মার্কিন সেনাঘাঁটিতে মার্কিন সেনা থাকা অবস্থায়ই ওই ঘাঁটিতে রুশ সেনারা ঢুকে পড়ে। রীতিমতো অবিশ্বাস্য ঘটনা।
অবশ্য কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। কারণ রুশ সেনারা ঘাঁটির ভেতরের একটি পৃথক ভবনে অবস্থান গ্রহণ করে। শুধু তা-ই নয়, রাশিয়ার পরম মিত্র উত্তর কোরিয়া বিশেষ প্রশিক্ষিত ৭০০ কমান্ডো প্রেরণ করেছে বুরকিনা ফাসোতে নিরাপত্তাঝুঁকি সহায়তায়। এরই মধ্যে মালি, নাইজার ও বুরকিনা ফাসো জোটবদ্ধ হয়ে কনফেডারেশন গঠন করেছে।
রুশ উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী ইউনুস বেক ইয়েভ কুরভের উপস্থিতিতে এই জোট গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। রাশিয়া তাৎক্ষণিকভাবে ওই জোটকে স্বীকৃতি দিয়ে নিরাপত্তা সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয়। পরে মস্কো থেকে বলা হয়, রাশিয়া নিরাপত্তা বা সামরিক চুক্তির চেয়েও বেশি কিছু করতে প্রস্তুত। এরই মধ্যে তার প্রমাণ মিলেছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করেছে মস্কো।
বিশেষ করে দ্রুততম সময়ে ওয়াগাদুগুতে একটি স্বর্ণ শোধনাগার নির্মাণ করে দিয়ে বুরকিনা ফাসোর স্বর্ণশিল্পে যুগান্তকারী পদক্ষেপে অংশগ্রহণ করেছে। ওই স্বর্ণ শোধনাগারে বছরে ১৫০ টন স্বর্ণ শোধন করা যাবে। অর্থাৎ বুরকিনা ফাসোতে বছরে ১৫০ টন স্বর্ণ উৎপাদন হবে, যা দেশটির অর্থনীতিকে অনেকটাই পাল্টে দেবে। সাহেলের তিনটি দেশ যৌথ সামরিক বাহিনী ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগের সঙ্গে চাদ ও টোগাও থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ২০২৪ সালের মে মাসে তারা যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করে।
গত নভেম্বরে (২০) চাদ ফ্রান্সের সঙ্গে তার প্রতিরক্ষা চুক্তি বাতিল করার পর রাশিয়া দেশটিকে বিকল্প নিরাপত্তা অংশীদারি প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একইভাবে এই বছরের (২০২৪) ফেব্রুয়ারিতে সুদান ও রাশিয়া ২০১৭ সালের একটি স্থগিত চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার চুক্তিতে পৌঁছেছে, যা ২০২৪ সালের এপ্রিলে সুদানের সশস্ত্র বাহিনীকে সীমাবদ্ধ সামরিক সহায়তা প্রদানের রাশিয়ার প্রতিশ্রুতি অনুসরণ করে রাশিয়াকে সুদানের লোহিত সাগরের উপকূলে একটি নৌঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেবে। এ ছাড়া ২০১৯ থেকেই লিবিয়ায় ওয়াগনার গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে।
এ থেকে এটি সুস্পষ্ট যে আফ্রিকায় রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি ও অর্থনৈতিক-কূটনৈতিক সহযোগিতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সাবেক সোভিয়েত যুগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সোভিয়েত যুগে রাশিয়ার প্রভাববলয় অনেক বিস্তৃত ছিল, পূর্ব ইউরোপ থেকে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। সোভিয়েত যুগে ওই প্রভাববলয় অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে নয়, গড়ে উঠেছিল আদর্শিক ভিত্তিতে। সমাজতন্ত্রের লড়াই-সংগ্রামের আদর্শের ভিত্তিতে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ওই প্রভাববলয় রাতারাতি শেষ হয়ে যায়। এমনকি খোদ রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় হয়। দেশটি পুঁজিবাদের পথ ধরে। হঠাৎ করে এই পরিবর্তনের ফলে দেশটি আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আর্থিক সহযোগিতা চাইতে হয়।
পুতিনের নেতৃত্বে পরিস্থিতি বদলে গেছে। রাশিয়া আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তারা সোভিয়েত যুগের মান-মর্যাদা ও শক্তি ফিরে পেতে চাইছে। এরই ফল হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রুশ প্রভাব বিস্তারের সাবেক সোভিয়েত নীতি ও কর্মপন্থা অনুসরণ। ইউক্রেন যুদ্ধ তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া তার সামরিক জোট ওয়ারশ ভেঙে দিয়ে ন্যাটোর কাছে একরকম নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছিল। সেই রাশিয়া এখন ন্যাটোকে পাত্তাই দিচ্ছে না। উপরন্তু ন্যাটোভুক্ত একাধিক দেশকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। এটি রাশিয়ার পুনরুত্থান বৈ আর কী-ই বা বলা যায়?
রাশিয়ার পুনরুত্থান শুরু হয় মূলত চীন, ইন্ডিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলকে নিয়ে ব্রিকস গঠন এবং ইরাক-সিরিয়ায় আইএস দমনে সেনা প্রেরণ ও সিরিয়ায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে। ১৬ বছর আগে ২০০৯ সালের ১৬ জুন এই ব্রিকস গঠিত হয়। বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা ১০। নতুন সদস্যরা হলো সৌদি আরব, ইরান, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইথিওপিয়া। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিসহ বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই সংস্থা গঠিত হয়।
অর্থাৎ ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক মেরুকেন্দ্রিকে যে বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি নয়া ব্যবস্থা- বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থা। আর সেই লক্ষ্য পূরণে অভিন্ন ব্রিকস মুদ্রা প্রচলনের চেষ্টা চলছে। এই অভিন্ন মুদ্রা চালু হলে মার্কিন ডলারের একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান ঘটবে। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্যও হ্রাস পাবে, এটি কমবেশি নিশ্চিত করে বলা যায়। সর্বোপরি আজকের বিশ্ব যে যুদ্ধের হুমকির মুখে, তা-ও অনেকাংশে মোকাবেলা করা যাবে। ঠিক যেমনটি আমরা দেখেছি সোভিয়েত যুগে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ