গুছিয়ে বলা আর গুছিয়ে লেখা- দারুণ দুই গুণ। কাজটা সবাইকে দিয়ে হয় না। আমাকে দিয়েও হয়নি। হওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। কেননা, ‘বেলা যে ফুরায়/আঁধার ঘনায়...।’
গুছিয়ে লিখতে পারাটা আমার পেশা বলবৎ রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা সত্ত্বেও এই গুণটা আমার ছায়ার কাছাকাছি হওয়ারও আগ্রহ দেখাল না। গুছিয়ে বলতে পারার চেষ্টা? না, ওটা আর করি না। যারা করে তারা আমার পর্যবেক্ষণ সীমায় করছে বিরাজ চিরকাল।
রাজনীতিকদের মধ্যে যাঁরা গুছিয়ে বলতে পারঙ্গম তাঁরা ‘নিজ যোগ্যতায়’ ভালো মিডিয়া কাভারেজ পেয়ে থাকেন। তাঁদের মুখ থেকে কিছু একটা বের করে পাঠক-শ্রোতার উদ্দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য গণমাধ্যমকর্মীরা যেন মুখিয়ে থাকেন। তিনজনকে মনে পড়ছে : অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, ড. আলিম আল-রাজি ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। তাঁদের ছিল কথননৈপুণ্য, সূক্ষ্ম রসবোধ আর প্রতিপক্ষের গায়ে হুল ফোটানোর চমৎকার মুনশিয়ানা।
যে বয়সটায় শক্তিমানের আস্ফালন দেখলে মাথায় রক্ত উঠে যেত, দেশটাকে দুনিয়াসেরা ফুলবাগান করার জন্য উতলা হতো চিত্ত, সুবাতাসরোধী পাহাড় ভেঙে দেওয়ার সংকল্পে দুলে উঠত প্রাণ, সেই ১৯৭২-৭৩ সালে নিত্যসন্ধ্যায় রাজধানীর পল্টন ময়দানে সবান্ধব উপস্থিতি অভ্যাস হয়ে পড়েছিল। ইদানীং যেমন তোপখানা রোডে সভা-সমাবেশ গলাবাজি, পল্টনও তখন সেরকম ছিল।
এক সন্ধ্যায় দেখি, অধ্যাপক মোজাফফর বক্তৃতা করছেন, বারবার বলবার পরও এই পচা অথর্ব বয়রা গভর্নমেন্ট নিজেকে শোধরায় না। এরা কানে কম শোনে। মিল রেখে যদি চোখে কম দেখত, সওয়া যেত। কিন্তু এরা শতভাগ অন্ধ। সেজন্য মানুষের দুঃখকষ্ট মন্ত্রী মিনিস্টারদের চোখেই পড়ে না। তাদের আত্মশুদ্ধির সময় আর দেওয়া হবে না। এখন সময় এসেছে নিকম্মা সরকারের বারোটা বাজিয়ে দেওয়ার। বলেন ঠিক না?
‘জ্বে। ঠিক ঠিক।’ সাড়া দেন শ তিনেক শ্রোতা। কিছুক্ষণ পরপর বক্তার প্রশ্ন, বলেন ঠিক কি না? শ্রোতারা উত্তর দেন, জ্বে। ঠিক ঠিক। একপর্যায়ে অধ্যাপক মোজাফফর বলেন, মুজিব সরকারের পদত্যাগ চাই। এই দাবি যারা সমর্থন করেন হাত তোলেন। শ্রোতারা সানন্দে হাত তুলে সমর্থন জানান।
‘বাহ্ কী সোন্দর।’ বলেন মোজাফফর, ‘হাত তুলে বসে আছেন। ভেবেছেন আপনাদের হাত দেখে নাচতে শুরু করব? আরে ভাই! আপনাদের তো আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। কাল যদি এই ময়দানে এসে মুজিব জানতে চান, মোজাফফরের ফাঁসি যারা চাও, হাত তোল। আপনারা সবাই এক হাত নয়, দুই হাত তুলে বলবেন, জ্বে। চাই, চাই।’
২.
পাড়াতুতো বড় ভাই অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন মাহমুদ ‘অতিথি বক্তা’ হওয়ার জন্য সদাপ্রস্তুত থাকতেন। সমাজসেবায় নিবেদিতপ্রাণরা তাঁদের আসন্ন অনুষ্ঠানে মহি ভাইয়ের সহৃদয় উপস্থিতি কামনা করতেন। এক সন্ধ্যায় তাঁর চেম্বারে বসে আছি; সঙ্গে বন্ধু দেলোয়ার। কতিপয় সমাজসেবী প্রবেশ করে এবং অমুক তারিখে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে মহি ভাইকে আশা করে। তিনি বলেন, তোমাদের সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক কাট। প্লিজ গেট লস্ট।
অপরাধটা কী বুঝলাম না স্যার! বললেন এক সমাজসেবী। মহি ভাই বলেন, ন্যাকামি কোরো না ফিরোজ। নজরুলজয়ন্তীতে আমার প্রেজেন্সে তোমরা সাজ্জাদ ঠিকাদারকে চিফ গেস্ট কর নাই? তোমরা কী করে ভাব যে প্রেস্টিজিয়াস লইয়ার মহিউদ্দিন আর ফ্রড টু দ্য হাইয়েস্ট অর্ডার সাজ্জাদ একই মঞ্চে পাশাপাশি বসবে। ফিরোজ বলে, ভুল হয়ে গেছে স্যার। মাফ করে দিন। সাজ্জাদ সাহেব এক হাজার টাকা কনট্রিবিউট করায়...।
কনট্রিবিউশন? আরে পাগল! ওটা ছিল ব্রাইবিং। বলেন মহি ভাই, ঘুষ আর চাঁদার মধ্যকার পার্থক্যই যদি না বুঝলে, সোশ্যাল ওয়ার্কও তো এই জনমে বুঝবে না। যাক সেসব। এখন, পনেরো শ
দিচ্ছি, কাজে লেগে যাও।
রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে মহিউদ্দিন মাহমুদ প্রধান অতিথি ছিলেন। আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে পাড়াতুতো ভাইয়ের ভাষণ শুনতে গেলাম। মহিউদ্দিন গুছিয়ে ও সংক্ষেপে বলতে দক্ষ। এই অনুষ্ঠানেও তাঁর বক্তব্য ছিল গোছানো সংক্ষিপ্ত। কিন্তু আমরা ওই ভাষণের বিন্দুবিসর্গও বুঝলাম না। কেন এমনতর ভাষণ?
অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন মাহমুদ বলেন, রবিঠাকুর আইন পেশায় যে অপরিসীম উপকার করেছেন সেজন্য তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশে আমি ওই ফাংশনে গিয়েছি। রবীন্দ্রনাথ ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত গিয়েছিলেন। তিনি ব্যারিস্টারি পড়েননি। যদি পড়তেন তাহলে ব্যারিস্টার রবির দাপটে অন্য লইয়াররা উপোস দিতে দিতে ইহলোক ত্যাগ করতে বাধ্য হতেন।
‘আমি রবি বিশেষজ্ঞ নই।’ বলেন মহি ভাই, ‘তাই এমনভাবে বক্তৃতা করি, শুনতে শুনতে শ্রোতাদের মাথা চক্কর দেয়। নিয়ম হলো, যে বিষয়টা তোমার কাছে কঠিন সেটাকে অন্যের জন্য আরও কঠিন করে তোলা। এলোমেলো বাক্যের জটলায় আবদ্ধ শ্রোতা তোমার বক্তৃতা শুনে মনে মনে বলবে, আহারে! আমি এত কম জানি! শ্রোতা হয়তো প্রার্থনা করবে- এই গুণীজনের মতোই জ্ঞানে গরিমায় আলোকিত হওয়ার শক্তি আমারে দাও হে দয়াময়!
দেলোয়ার বলে, চালাকি ধরা পড়লে? মহি ভাই বলেন, যারা ধরবে তারা বিলকুল নেগলিজেবল মাইনোরিটি। হায়রে কিছুই শিখলাম না- এরকম চিন্তকরা মেজরিটি। আমি বললাম, রবিঠাকুর আইনজীবীদের উপকার করার বিষয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ যা ভাবতেন আপনি তাই ভাবেন। বিস্মিত মহি ভাই আমাকে এক শ টাকার একটা নোট দিয়ে বলেন, ওমাই গড! নে। এটা টি ফর কে। আই মিন টাকা ফর নলেজ।
৩.
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল মনোনীত প্রার্থী মুস্তাফিজুর রহমান ১৯৮৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কলেজে আমরা সহপাঠী ছিলাম। মুস্তাফিজ টানা ৬০/৭০ মিনিট বক্তৃতা করতে পারতেন। তাঁর ভাষণের স্টাইল ছিল, ‘বন্ধুগণ! আমি আর সময় নেব না। দুই মিনিটের মধ্যে শেষ করছি।’ এই ওয়াদা তাঁকে রক্ষা করতে ছাত্রজীবনে দেখিনি। এমপি জীবনে করেছেন কি না, জানি না।
নবীন ছাত্রবরণ অনুষ্ঠানে সেনাপতি আইউব খানের দুঃশাসনের ওপর আবেগাত্মক ভাষায় বক্তৃতা করার পর্যায়ে মুস্তাফিজুর রহমান প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর বলেছেন, ‘বন্ধুরা আমি জানি আপনারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগের জন্য অপেক্ষমাণ। তাই, দুই মিনিটের মধ্যে আমার বক্তব্য শেষ করব।’
চল্লিশ মিনিটের সময় আরেক সহপাঠী ফখরুল ইসলাম হাঁক মেরে বলেন, খালি শেষ করুম শেষ করুম কইতেছস, করস্না কিয়েল্লাই? কয় ঘণ্টায় তোর দুই মিনিট য়্যাঁ? মুস্তাফিজ একটুও না ঘাবড়িয়ে শ্রোতাদের কাছে প্রশ্ন রাখেন, ভাইসব! আপনারা কি বিরক্তবোধ করছেন? শ্রোতাদের জবাব : না। না।
‘কিন্তু আমার বন্ধু ফখরুল বিরক্ত হয়েছেন’ বলেন মুস্তাফিজ, ‘তাই, এখানেই ইতি। সবাইকে ধন্যবাদ।’ শ্রোতাদের সারিতে আমি আর ফখরুল পাশাপাশি বসা। ফখরুল বলেন, দেইখছসনি। হারামিটা ক্যামতে আমারে ইনসাল্ট করল!
ড. আলিম আল-রাজি চমৎকার ভঙ্গিতে প্রতিপক্ষের দিকে বাক্যবাণ ছুড়তেন। ১৯৭৫ সালে সামরিক আইনের শাসনাধীন বাংলাদেশে খোন্দকার মোশতাক আহমদের পর রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। জনসভায় বক্তৃতাকালে ড. রাজি বলেন, একটা কথা আছে উঠ্ ছেমরি তোর বিয়া। আমাদের সায়েম সাহেবেরও হয়েছে সেই দশা। ওনারে কওয়া হয়েছে, আসেন বসেন আপনি এখন প্রেসিডেন্ট। উনি বলেন, বেশ বেশ! এরপরই তিনি করলেন বিশ্বরেকর্ড! চিফ জাস্টিস সায়েম হলেন চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর! দুনিয়ার কোথাও এরকম ঘটনা আমরা দেখি নাই!
১৯৭৩ সালে পল্টনে এক জনসভায় ড. আলিম আল-রাজি বলেন, যখনই কোনো দাবি ওঠে সরকার থেকে বলা হয়, ধৈর্য ধরেন। ত্যাগ স্বীকার করেন। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। সরকারের বশবর্তী আমরা ত্যাগ শুরু করে দিলাম। ঘিয়ে ভাজা খাওয়া ত্যাগ করলাম। দামি জামাকাপড় কেনা ত্যাগ করলাম। এভাবে আদা রসুন আলু পিঁয়াজ গরুর গোশত, খাসির গোশত, মুরগির গোশত, রুই কাতলা বোয়াল ইলিশ পাঙাশ শিং মাগুর সবই ত্যাগ করলাম। তারপরও সেদিন চট্টগ্রামে এক মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, আরও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।
‘আমরা আর কত ত্যাগ করব হে জাতির জনক।’ বলেন ডা. রাজি, ‘আমরা তো কিছুই রাখিনি। সবই ত্যাগ করেছি। বাকি শুধু আমাদের প্রাণত্যাগ।’
৪.
বিরোধী দলগুলো জাতীয় পার্টিকে (জাপা) আর সময় দেবে না। এবার তারা সরকারের পতন ঘটাবেই ঘটাবে। ১৯৮৯ সালের শেষভাগে রাজনৈতিক পণ্ডিতরা এরকম বাণী দিচ্ছিলেন। কারণ তখন ঘনঘন ‘৭২ ঘণ্টার হরতাল’ কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছিল। সে সময় আমার কর্মস্থল ছিল রাজধানীর শান্তিনগর এলাকায়। কর্মস্থলের সামনের রাস্তা দিয়ে যাতায়াতের সময় সরকারি দল জাতীয় পার্টির নেতা ও মন্ত্রীরা আমাদের অফিসে সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতেন।
উপপ্রধানমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এক রাতে এলে তাঁকে সাংবাদিক আলতাফ মাহমুদ বলেন, আবার ৭২ ঘণ্টার হরতাল শুরু হচ্ছে কাল। জোট নেতারা নিশ্চিত, এবার সরকারের পতন হবেই হবে। শাহ মোয়াজ্জেম সহাস্যে বলেন : আপনারা তো হরতালের সময় ঢাকাতেই থাকবেন। দেখবেন সরকার পতন দূর কথা, পিন পতনও হয়নি।
১৯৮৬-এর সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে রফা হয় যে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা তাঁদের প্রচারণা পোস্টারে রাষ্ট্রপতি এরশাদের ছবি ব্যবহার করবেন না। কিন্তু তাঁরা এরশাদের ছবি ব্যবহার করেই চলেছেন। এ ব্যাপারে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে শাহ মোয়াজ্জেম বলেন, ঠিক আছে। বিরোধীদলীয় প্রার্থীরাও তাঁদের পোস্টারে এরশাদের ছবি ছাপতে পারেন। সরকার আপত্তি করবে না।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন