বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ধনী মানুষদের দেশও এটি। তবে ধনী দেশেও গরিব, মধ্যবিত্ত আছে। সেখানেও আছে মানুষের মনে এন্তার হতাশা। মানুষের মৌলিক চাহিদা বাসস্থান, পণ্যমূল্য, পরিবহন সেবায় অসমতা, শিশু-কিশোরের চিকিৎসা ব্যয় ইত্যাদি মৌলিক বিষয়েও নিউইয়র্ক সিটির মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বিশ্বের মানুষের দৃষ্টি ছিল নিউইয়র্ক সিটি নির্বাচনের দিকে। এই সিটি যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। উৎপাদন, আয় এবং রাজনীতি সচেতন নাগরিক সমাজ। যেখানে বহু মিলিয়নিয়ার-বিলিয়নিয়ার মানুষের বসবাস। পাশাপাশি আছে তুচ্ছতাচ্ছিল্যে বেড়ে ওঠা নিম্ন মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী। নাগরিক জীবনের মানক্ষয়িষ্ণু, হেনস্তাগ্রস্ত মধ্যবিত্তরা মৌলিক নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সীমিত আয় করে খরচের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। প্রমাণিত হয়েছে, ধনীর দেশেও বৈষম্য আছে। এই মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর হতাশা কাটাতে সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন পৃথিবীর নিউইয়র্কের ৮৪ লাখ মানুষ। জীবনমান সমুন্নত রাখতে নেতা বাছাইয়ে বিস্ময়কর চমক সৃষ্টি করলেন। নিউইয়র্ক সিটির ১১৩তম মেয়র ৩৪ বছর বয়সি টগবগে তরুণ জোহরান মামদানি। তিনি সংখ্যালঘু, অভিবাসী প্রবাসী মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। এটি মধ্যবিত্ত ভোটারদের জাগরণ, হেনস্তা অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায়। শত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নেতৃত্বের নতুনধারা তৈরি করলেন। যাঁদের আয় সীমিত, আছে লড়াই করার প্রচেষ্টা এবং দৃঢ়প্রত্যয়- তাঁরাই জয়ের মালা পরালেন পরীক্ষিত সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে গণতন্ত্রপন্থি মামদানির গলায়। তিনি মুসলিম, জিহাদি, জঙ্গি, ফিলিস্তিনপন্থি, সমাজতন্ত্র-ঘেঁষা সবই তাঁর মাথায় চাপানো হলো। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁকে ভোট দিতে জনগণকে বিরত থাকতে বললেন। অবশ্য মামদানি থেমে থাকেননি। তিনি চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে ট্রাম্পকে একনায়ক আখ্যা দিলেন। ১২ মাস ধরে প্রচারণায় কৌশল পরিবর্তন করলেন। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে পাশে নিলেন। ১ লাখ স্বেচ্ছাসেবক তরুণ-তরুণী স্বেচ্ছায় তার নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নিলেন। রক্তচক্ষুকে পরাজিত করলেন। খেটে খাওয়া প্রান্তিক মধ্যবিত্ত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় হেরে গেল অভিজাত সমাজ। এই বিজয় বিশ্বকে নাড়া দিল। তাবৎ জ্ঞানী-গুণীর নেতিবাচক-ইতিবাচক বিচার-বিশ্লেষণ। এমনকি তাঁর মার্কিন নাগরিকত্ব নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। জাতিগত ও ধর্মীয় প্রাচীর তৈরি করা হলো। কিন্তু বিশ্ববাসী মামদানির এই বিজয়কে ভিন্ন উচ্চতায় স্থান দিলেন। গোটা বিশ্বে পিছিয়ে পড়া স্বল্প আয়ের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালেন। সব বাধা ভিত্তিহীন অপপ্রচার অসার বলে প্রমাণিত হলো। বিশ্বের প্রচার মাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ব্যতিক্রমধর্মী এই তরুণ মামদানি। জেগে উঠেছে মধ্যবিত্ত জনগণ, প্রতিষ্ঠিত হবে নতুনধারার রাজনীতি।
সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকানদের মতভেদ সম্পর্কে ভুক্তভোগীরা জানেন। হেন রাজনৈতিক কৌশল নেই যে, তাঁরা পারস্পরিক বিরোধিতায় ব্যবহার করেন না। তবু নিউইয়র্ক সিটির নগরপিতা এই আশ্বাসটুকু পেলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প পণ্যের ২৫ ভাগ মূল্য হ্রাস করবেন, ফেডারেল বাজেটে কাটছাঁট করবেন না, শিশু-কিশোরের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবহন, মধ্যবিত্ত পরিবারের আবাসন সংকট সমাধানে মেয়রের পাশে থাকবেন। হয়তো মামদানির চলার পথ সুকোমল হবে না; তবু তাঁর বিজয়ের গল্প প্রান্তিক মধ্যবিত্তের বিশাল অর্জন বলে প্রতীয়মাণ। তিনি সব সমস্যার সমাধান দিতে পারবেন না এ কথা বাস্তব; কিন্তু তাঁর প্রতিশ্রুতি ও প্রচেষ্টাকে মূল্যায়ন করবেন তাঁর সমর্থক গোষ্ঠী। এই মেলবন্ধনকে ভলতেয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তির সরল অভিব্যক্তি- ‘তোমার মতের সঙ্গে মেরু-দূর পার্থক্য থাকতে পারে, তবু তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেব না।’ মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনের পর মামদানি-ট্রাম্প ভিন্ন চেহারায় আবির্ভূত হয়েছেন। সবাই রাজনৈতিক বৈরিতা ভুলে নিউইয়র্ক সিটি রক্ষা করা তথা মধ্যবিত্তের স্বার্থ রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন। এটি আমেরিকার জনগণের স্বার্থ রক্ষার অঙ্গীকার ও মেলবন্ধন। জাতি এবং জাতীয়তা বোধ জাগরূক থাকুক ‘মামদানি মুহূর্তে’। দুই মেরুর দুই নেতার কার্যকর সংযোগের মাধ্যমে পৃথিবীতে সমাজ-রাষ্ট্রের শিক্ষণ কী? চীনের বিখ্যাত দার্শনিক কনফুসিয়াসের একটি উক্তি- ‘গভীর অন্ধকারের মধ্যে একটি মোমবাতির আলো আগামী দিনের আশার আলো জাগায়।’ সুশাসন, সুসম্পর্ক, কার্যকর সংযোগ ও মেনে নেওয়ার নীতি মেরু-দূর মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সহজে পথচলা যায়। তাই বলি, সময়ের তালে জেগে উঠবে মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। শাবাশ মামদানি, শাবাশ মানবতা, শাবাশ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।
লেখক : কলাম লেখক