অবিশ্বাস! ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু প্রভাব অনেক গভীর। মুহূর্তের মধ্যে বিষিয়ে তোলে জীবন। সুন্দর সম্পর্কগুলো ঝড়ের গতিতে লন্ডভন্ড করে দেয়। দূরে কোথাও উড়িয়ে নিয়ে আছড়ে ফেলে, উপড়ে ফেলে শিকড়। প্রতিটি মানুষই আলাদা, চলনেবলনে ব্যক্তিত্বে। তারপরও চমৎকার বোঝাপড়া। কিন্তু হঠাৎ করেই এক দিন আকাশে কালো মেঘ। ভালোবাসায় মোড়া সুন্দর জীবন উপভোগ করতে করতেই ছন্দপতন। কোনো কিছুই ঠিকমতো হচ্ছে না। সম্পর্কটা কেমন যেন বেসুরা ঠেকছে। সবতাতেই তাল কেটে যাচ্ছে। সম্পর্ক সব সময় সরল গতিতে চলে না। কখনো কখনো খাদের কিনার ঘেঁষে দাঁড়ায়।
যে কোনো সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা। বিশ্বাসই একটা সম্পর্ককে দৃঢ় করে। আস্থা ও নির্ভরতা তৈরি হয় বিশ্বাস থেকে। সম্পর্ক তৈরি করা খুব সহজ। পথ চলতে চলতে সম্পর্ক তৈরি হয়, আবার পথ চলতে চলতেই তা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে হলে, গভীর করতে হলে দরকার বিশ্বাস। বিশ্বাস অর্জন শুধু মুখের কথায় হয় না। কর্মক্ষেত্রে তার প্রমাণ রাখতে হয়। কিন্তু সেটারই বড় অভাব আজকাল। আমরা একে অন্যের ওপর আস্থা রাখতে পারি না।
ভোগবাদী পৃথিবীতে সবাই শুধু নিজেকে ভালোবাসে। অন্যের দুঃখে, অন্যের কষ্টে, অন্যের বিপদে কেউ পাশে এসে দাঁড়াতে চায় না। তবে এমন মানুষও আছে যারা অন্যের জন্য করে। অন্যের বিপদে পাশে এসে দাঁড়ায়। তারা বিনিময়ে কিছুই চায় না। কারও উপকার করার মধ্যে যে আনন্দ আছে সেটাই তার বিশ্বাস। এই বিশ্বাসটাই একটি সম্পর্ককে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে। অর্থাৎ নিশ্বাস আর বিশ্বাসটাই সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখে।
বিশ্বাস এমন একটি জিনিস, যা প্রতিটি মানুষের অন্তরে সৃষ্টিকর্তা খুব সূক্ষ্মভাবে বসিয়ে দেন, যা চোখে দেখা যায় না কিন্তু অনুভব করা যায়। একটি ছোট্ট শিশুকে যদি তার বাবা ওপরের দিকে শূন্যে ছুড়ে দেন, সেই বাচ্চাটি আনন্দে হাসতে থাকে। কারণ, সে জানে তার বাবা তাকে অবশ্যই কোলে তুলে নেবেন এবং সে আঘাত পাবে না। আর সেই বিশ্বাস থেকেই শিশুটি আনন্দের সঙ্গে হাসতে থাকে।
একজন বিদেশগামী মানুষ তার স্ত্রীর কাছে সব সম্পদ এবং পরিবার গচ্ছিত রেখে, গভীর বিশ্বাস নিয়ে ছুটে যান দূর দেশে। সেই মানুষটি দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে উপার্জিত অর্থ স্ত্রীর নামে তার অ্যাকাউন্টে পাঠান। এখানেও কাজ করে গভীর বিশ্বাস। অর্থাৎ আমাদের প্রত্যেকের জীবনে বিশ্বাস শব্দটার গুরুত্ব অনেক বেশি। পৃথিবীতে যত কিছু হয় সব বিশ্বাসের ওপর হয়। আমাদের জীবনে ভালো কিছু করতে হলে বিশ্বাসের সঙ্গে করতে হয়। তাই তো রবিঠাকুর বলেছেন-‘অবিশ্বাস করে অবিচার করার চেয়ে বিশ্বাস করে ঠকা ভালো।’
আবার এই বিশ্বাসেরও রয়েছে প্রকারভেদ। যেমন : সরল বিশ্বাস, জটিল বিশ্বাস, কুটিল বিশ্বাস, গরল বিশ্বাস, দৃঢ় বিশ্বাস, লোকদেখানো বিশ্বাস ইত্যাদি। এর বাইরেও আরও অনেক বিশ্বাস আছে। যেমন : দেবব্রত বিশ্বাস, অপু বিশ্বাস, দিলীপ বিশ্বাস, আবদুর রহমান বিশ্বাস ইত্যাদি।
এ ছাড়া আরও অনেক বিশ্বাস নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। যেমন : সুদিন আসবে, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, দুর্নীতি-নারী নির্যাতনমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, বিশ্বকাপ ক্রিকেটে একদিন বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হবে, ছেলে মানুষ হবে, সংসারে নাতবউ আসবে। ছোটবড় থেকে বৃহত্তর নানান ধরনের বিশ্বাসকে আশ্রয় করেই মানুষ বাঁচে। আবার বিশ্বাসকে ভর করেই মানুষ প্রাণ দেয়, প্রাণ নেয়। আসলে বিশ্বাসের কোনো সূত্র নেই, সংজ্ঞাও নেই। বিশ্বাস করলেও করা যায়, না করলেও করা যায়।
খরার দেশের একটি গল্প দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করছি। প্রচণ্ড খরা চলছে দেশজুড়ে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর-এক বিন্দু বৃষ্টি নেই। আকাশে এক টুকরো মেঘ নেই। সেই রাজ্যে ফুল নেই, ফল নেই, ফসল নেই। অবশেষে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল-তারা বৃষ্টিদেবীর আরাধনা করবে, বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করবে। একটি শুভদিন বেছে নিয়ে সাব্যস্ত হলো, সবচেয়ে বড় মাঠে সন্ধ্যাবেলায় উপস্থিত হয়ে সবাই বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করবে। নির্দিষ্ট সন্ধ্যায় প্রার্থনার স্থানে সব লোক জড়ো হলো। সবাই ঠিকঠাক এসেছে, শুধু একজন হাস্যকর চরিত্রের মানুষ একটি ছাতা সঙ্গে নিয়ে এসেছে। ‘সন্ধ্যাবেলা ছাতা দিয়ে কী হবে?’ সবার কৌতূহলী প্রশ্নের জবাবে সে বলল, ‘আগে বল, তোমরা ছাতা আননি কেন?’ সবাই বলল, ‘ছাতা? ছাতা দিয়ে কী হবে? সন্ধ্যাবেলা কি রোদ উঠবে?’ তখন সে জবাবে বলল, আমরা এসেছি বৃষ্টির প্রার্থনায়। বৃষ্টি তো আসবে। তখন ভিজতে হবে তোমাদের। সেদিন প্রার্থনা শেষে সত্যিই মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছিল। সব অবিশ্বাসী মানুষ ভিজে চুপসে গিয়েছিল। শুধু সেই মানুষটি যে বিশ্বাস করেছিল সবাই মিলে প্রার্থনা করলে বৃষ্টি হবে, ভীষণ বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় দিয়ে সে একাকী বাড়ি ফিরেছিল!
পৃথিবীতে এমন দেশও আছে, যেখানে মধ্যরাতে সূর্যের দেখা পাওয়া যায়। শুধু তা-ই নয়, অনেক সময় সেখানে দিনের পর দিন সূর্যের দেখাই মেলে না। এই বিচিত্র নিয়মের দেশটি হলো নরওয়ে। বিশ্বজুড়ে এই দেশের পরিচিতি ‘নিশীথ সূর্যের দেশ’ হিসেবে। নরওয়েতে রয়েছে কয়েকটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা এবং উদ্ভাবনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত হয়, যেখানে উন্নতমানের শিক্ষা এবং গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে।
মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাসের মাত্রা যেন দিনদিন তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। একে অপরকে বিশ্বাস করে না বললেই চলে। নরওয়ের একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়টির ওপর একদল গবেষক কিছু নির্ধারিত মানুষ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, ৩৭ ভাগ মানুষ অন্যকে বিশ্বাস করেন স্বাভাবিকভাবেই। ৫৮ ভাগ অন্যকে সহজে বিশ্বাস করে না। আর ৫ ভাগ কোনো উত্তর দেয়নি। আবার এই ৫৮ ভাগ মানুষ যারা অন্যকে বিশ্বাস করে না তারা তুলনামূলকভাবে সন্দেহপ্রবণ ও কিছুটা জটিল প্রকৃতির। আর ৩৭ ভাগ মানুষ সরল প্রকৃতির। যারা সরল প্রকৃতির তারা সাধারণত নিজের ভিতরে রাগ অভিমান না পুষে রেখে অন্যকে ক্ষমা করে দেন। অর্থাৎ তাদের চিন্তাভাবনা সব সময়ই পজিটিভ।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, সন্দেহপ্রবণ মানুষের তুলনায় যারা সরল প্রকৃতির, চিন্তাভাবনা পজিটিভ, মানুষকে বিশ্বাস করে, তারা বেশি দিন বাঁচে। তাদের হৃদ্যন্ত্রজনিত রোগ তুলনামূলকভাবে কম এবং পারিবারিকভাবেও তারা সুখী জীবনযাপন করে থাকে। গবেষকরা মনে করেন, মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটিয়ে, উদার চিন্তাভাবনার সাহায্যে সুন্দর জীবনযাপন ও দীর্ঘায়ুর অধিকারী হতে পারাটাই মানব জীবনের প্রকৃত সফলতা। তবে এ বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, প্রতিপালন করতে হয়।
মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস। আর এ বিশ্বাসই আমাদের অন্যের ওপর নির্ভর করতে, সম্পর্ক গড়তে এবং জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সাহায্য করে। দিন শেষে এই বিশ্বাসই মানুষকে আশাবাদী করে তোলে। হাজার বছর বেঁচে থাকার ইচ্ছা জাগায়। অনন্য হয়ে বাঁচতে শেখায়। অন্যদিকে অবিশ্বাস মানুষের অন্তরে অন্ধকারের জন্ম দেয় এবং তা ধীরে ধীরে প্রকট হতে থাকে। মানুষের নীতি ও নৈতিকতাকে দুর্বল করে দেয়। একটি সুন্দর সম্পর্ককে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব অকারণে ছুটে যায়। সামান্য স্বার্থের কারণে ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের সম্পর্ক ভেঙে যায়। অফিসে বসের সঙ্গে তার অধস্তন, এমনকি চাকরি পর্যন্ত চলে যায়।
ব্যক্তিত্বের সংঘাত থেকেও অনেক সম্পর্ক ভেঙে যায়। নৈতিকতা ও আদর্শিক কারণেও সম্পর্ক ভাঙে। আমার নিজের ক্ষেত্রে যত সম্পর্ক ভেঙেছে তার বেশির ভাগই আদর্শিক কারণে। আমি কখনো কারও সঙ্গে ঘোষণা দিয়ে সম্পর্ক নষ্ট করিনি। কাউকে কখনো দোষারোপও করিনি। নীরবে দূরে সরে গেছি।
আসলে আমি ছোটবেলা থেকেই একটু ইনট্রোভার্ট। সব সময় আমার ভিতর কেমন যেন একটা শাইনেস কাজ করে। কখনো কিছু চাইতেও পারি না, আবার মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারি না। তাই জীবনে অনেক কিছুই পাইনি। তবে এটা ভেবে কখনো আফসোসও করি না। মনে মনে ভাবি সৃষ্টিকর্তা যতটুকু নির্ধারণ করে রেখেছেন ততটুকুই পেয়েছি। মানুষকে খুব সহজে বিশ্বাস করি। আর এটাই আমার বড় দোষ। মিষ্টি করে কেউ কথা বললে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে যাই। আর এজন্যই জীবনে বহুবার ঠকেছি। এই তো সেদিন গরুর মাংস কিনতে গিয়ে ঠকে এলাম। একটা বড় ঝুলন্ত মাংসের খণ্ড দেখিয়ে বললাম-এটা যতটুকু হবে কেটে পিস পিস করে দেবেন। টেলিফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলায় ব্যস্ত ছিলাম। ওই ফাঁকে কসাই বেশ কিছু বড় বড় হাড় ও চর্বি মাংসের ভিতরে চালান করে দিয়েছে। বাসায় এসে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওয়াইফ শুধু বলল, আর কত ঠকবা! আধ্যাত্মিক লাইনের একটা জবাব আমার জানা ছিল, আর তাই বললাম-আমি ঠকিনি ওই মাংস বিক্রেতাই ঠকেছে।
সত্যি কথা বলতে কি, আমরা এখন বিশ্বাসশূন্যতায় বসবাস করছি। ব্যক্তি থেকে সমাজ ও জাতি সর্বক্ষেত্রেই যেন অবিশ্বাসের দাপট। কেউ কাউকে বিশ্বাস করি না। অনেক সময় নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে দ্বিধা হয়। মনে হয় আমি বুঝি ভুল দেখছি, কিংবা যা দেখছি তা ভুল। তাই হয়তো শ্রুতিকথা এখন বেশি গ্রহণযোগ্য। এভাবেই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে বয়ে যায় আমাদের জীবননৌকা। তাইতো ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক কবি জন কিটস বলেছেন, ‘বিশ্বাসহীনতায় বেঁচে থাকা আর ঘন কুয়াশার মধ্যে গাড়ি চালানো দুটো একই ব্যাপার।’
বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের এই খেলা আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা যখন কাউকে বিশ্বাস করি তখন আমাদের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তা ও শান্তির অনুভূতি কাজ করে। আর যখন অবিশ্বাস করি তখন সম্পর্কের মাধুর্য হারিয়ে যায়। তাই প্রতিটি সম্পর্কের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করা এবং নিজের আচরণের প্রতি সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়, যাতে বিশ্বাস অটুট থাকে এবং সম্পর্ক আরও মজবুত হয়।
বিশাল মহাজগতে ক্ষুদ্র বালুকণার চেয়েও ছোট্ট এ পৃথিবী, নশ্বর জীবন তবু বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক