হাতির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করছেন সংরক্ষণবাদীরা। মানব-বন্যপ্রাণী সংঘাত আরও বাড়তে পারে এমন আশঙ্কা করছেন তারা। বতসোয়ানার বৃহত্তম বার্ষিক হাতি শিকার অভিযান নিয়ে তারা গভীর উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন। বিশ্বের বৃহত্তম হাতির বাসস্থল বতসোয়ানা।
মোট ২৩ লাখ মানুষের দেশটির বেশিরভাগ শুষ্ক। এখানে এক লাখ ৩০ হাজার হাতি বসবাস করছে।আফ্রিকার মোট হাতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই দেশটিতে বসবাস করছে। উল্লেখ্য, আফ্রিকায় মোট সোয়া চার লাখ হাতি রয়েছে। যেখানে সারা বিশ্বে হাতির সংখ্যা প্রায় চার লাখ ৬০ হাজার।
২০১৯ সালে বতসোয়ানা সরকার হাতির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং গ্রামীণ সম্প্রদায়ের জন্য শিকার থেকে রাজস্ব আয়ের উদ্দেশ্যে পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিল। তবে, সম্প্রতি ঘোষিত বার্ষিক ট্রফি শিকারের কোটা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানোয় সংরক্ষণবাদী এবং বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলছেন, এই সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে হাতির স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে এবং মানব-বন্যপ্রাণী সংঘাত আরও বাড়াতে পারে।
এলিফ্যান্ট প্রোটেকশন সোসাইটির (ইপিএস) প্রতিষ্ঠাতা ওটস নাওয়া আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, শিকার করা হাতির সংখ্যা অনেক বেশি। সরকারকে এই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
নতুন শিকার কোটা
প্রাথমিক সরকারি খসড়া অনুযায়ী, ২০২৬ সালের জন্য ট্রফি শিকারের কোটা ৪১০ থেকে বাড়িয়ে ৪৩০টি হাতি নির্ধারণ করা হয়েছে। ট্রফি শিকার বলতে হাতির দাঁত, গণ্ডারের শিংয়ের মতো মূল্যবান অংশ সংগ্রহের জন্য হাতি, সিংহ বা গন্ডারের মতো বন্যপ্রাণী বৈধভাবে শিকার করাকে বোঝায়। বতসোয়ানার সুবিশাল প্রাকৃতিক দৃশ্য বহু দিন ধরেই বন্যপ্রাণী দেখতে ইচ্ছুক বিদেশিদের আকর্ষণ করে আসছে।
২০১৪ সালে দেশটি ট্রফি শিকারের উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও পাঁচ বছর পর তা বাতিল করে দেয়। কারণ হিসেবে তারা জানায়, হাতির সংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় কৃষকদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়ছে। এখন সরকার হাতি, গন্ডার এবং জলহস্তীসহ এক ডজনেরও বেশি প্রজাতির জন্য বার্ষিক শিকার কোটা বরাদ্দ করে। নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে এবং তানজানিয়ার মতো অন্যান্য আফ্রিকান দেশগুলিতেও হাতিসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার জন্য ট্রফি-শিকারের কোটা রয়েছে।
সরকারের যুক্তি
বতসোয়ানা সরকারের যুক্তি হলো, এই বড় প্রাণীগুলির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ট্রফি শিকার গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন এবং বন উজাড়ের কারণে হাতির প্রাকৃতিক বাসস্থান ও খাদ্য উৎস কমে যাওয়ায় তারা ক্রমশ মানুষের সঙ্গে সংঘাতে জড়াচ্ছে। এর ফলে, বিভিন্ন আফ্রিকান দেশে হাতিরা ফসলের ক্ষতি, সংরক্ষিত শস্য খাওয়া এবং ঘরবাড়ি, বেড়া ও জলের অবকাঠামো নষ্ট করার জন্য ব্যক্তিগত বাড়িতে এবং গ্রামে প্রবেশ করেছে বলে জানা যায়।
বতসোয়ানার সাবেক প্রেসিডেন্ট মোকগুইৎসি মাসিসি গত বছর জার্মান সরকারের হাতিদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করে বলেছিলেন, জার্মানদের একবার হাতির মাঝে বাস করার চেষ্টা করা উচিত। তিনি দাবি করেছিলেন, তার দেশে হাতির সংখ্যা বিস্ফোরণের ফলে এক ধরণের মহামারী সৃষ্টি হয়েছে।
বতসোয়ানা সরকার বলছে, এই নিয়ন্ত্রিত শিকার একটি অত্যন্ত মূল্যবান রাজস্বের উৎস। পরিবেশ মন্ত্রী উইন্টার মমোলতসি এ বছরের শুরুতে জানিয়েছিলেন, ২০২৩ সালে ২.৭ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় ২০২৪ সালে শিকারের লাইসেন্স বিক্রি করে দেশটি ৪ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করেছে। এই অর্থ সংরক্ষণ ও সম্প্রদায়-নেতৃত্বাধীন প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়। প্রাণীর ওপর নির্ভর করে শিকারের লাইসেন্সের জন্য ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
সমালোচকদের উদ্বেগ
ওয়াইল্ডলাইফ চ্যারিটি ‘বর্ন ফ্রি’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী সভাপতি উইল ট্র্যাভার্সের মতে, বতসোয়ানার হাতির ট্রফি শিকারের কোটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গভীর জৈবিক উদ্বেগ সৃষ্টি করে। তিনি আল জাজিরাকে ইমেলের মাধ্যমে জানান, জৈবিক উদ্বেগের কারণ হলো ট্রফি শিকারিরা সেইসব প্রাণীদের লক্ষ্য করে যাদের তারা ট্রফি মনে করে... হাতির ক্ষেত্রে যাদের দাঁত সবচেয়ে বড়, অর্থাৎ পূর্ণবয়স্ক পুরুষ হাতিদের।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, এই দীর্ঘজীবী বয়স্ক হাতিরা হাতির সমাজে বেঁচে থাকার গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানের আধার, স্ত্রী হাতিদের কাছে কাঙ্ক্ষিত এবং বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত সফলভাবে প্রজনন করতে পারে। তিনি আরও বলেন, তারা চোরাশিকারি ও ট্রফি শিকারিদের লক্ষ্যবস্তু। যা এই ক্ষুদ্র সংখ্যক প্রাণীর উপর আরও চাপ সৃষ্টি করে, যাদের সংখ্যা বতসোয়ানার জাতীয় হাতির পালের মাত্র ১ শতাংশ বলে অনুমান করা হয়।
এছাড়াও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ধরনের হাতিদের সরিয়ে ফেললে তাদের আচরণে পরিবর্তন আসে, যা আসলে পার্শ্ববর্তী মানব সম্প্রদায়ের সাথে সংঘাত কমানোর পরিবর্তে বাড়িয়ে দিতে পারে। ইপিএসের নাওয়া বলেন, যেহেতু সম্প্রদায় এই প্রাণীগুলির একই পরিবেশে বাস করে, তাই তারা প্রায়শই এমন বন্যপ্রাণীর সম্মুখীন হয় যারা উত্যক্ত হতে পারে বা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
বিকল্প পথ
নাওয়া মনে করেন, হাতিদের সঙ্গে মানুষের মিথস্ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য কর্তৃপক্ষকে কমিউনিটি-ভিত্তিক পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। স্থানীয় বাসিন্দাদের বন্যপ্রাণীর সঙ্গে একত্রে বসবাসের জন্য জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে সজ্জিত করার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি বলেন, সরকার যদি পানির জন্য ব্যবহৃত বোরহোলগুলিকে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত করার নীতি গ্রহণ করে, তবে বতসোয়ানার সম্প্রদায়গুলি হাতিদের পাশে থেকে উপকৃত হতে পারে। তিনি একটি স্থানীয় হাতি রিসোর্টের উদাহরণ দিয়ে জানান, সেখানে প্রচুর বোরহোল খনন করা হয়েছিল, যা হাতিদের আকর্ষণ করে এবং অনেকে হাতি দেখতে খুব কাছ থেকে ভিড় করে।
নাওয়া উপসংহারে বলেন, সম্প্রদায়কে হাতির ভূমিকা বিশেষ করে বাস্তুতন্ত্রে তাদের গুরুত্ব এবং কীভাবে তাদের হত্যা না করে বা বাধা না দিয়ে হাতি থেকে সরাসরি উপকৃত হওয়া যায়, তা বোঝার জন্য শিক্ষিত করা প্রয়োজন।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল