“দূরে যাব বলেই আজ বসেছি এত কাছে,
হারানোর মাঝেও যেন কিছু প্রাপ্তি বাঁচে।
তুমি রবে না জানি, তবুও এই গোধূলি-লগন,
আমার শূন্য বুকে আঁকুক তোমার লিখন।”
বিকেলের শেষ আলোটুকু ঠিক প্রিয়র চোখের কোণায় এসে পড়েছে। ধানমন্ডি লেকের ধারের এই পরিচিত বেঞ্চটায় আজ যেন এক অদ্ভুত স্তব্ধতা। প্রিয়র কণ্ঠে শায়েরিটা শুনে পূর্ণিমা চমকে ওঠে না, বরং এক স্থির নদীর মতো শান্ত হয়ে যায়। তার চোখের পল্লবগুলো সামান্য কাঁপে, যেন বাতাসের ঝাপটায় নিভে যাওয়া প্রদীপের শেষ শিখা। পূর্ণিমা মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তার আঙুলগুলো শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে ধরছে শক্ত করে। এই নীরবতা সম্মতির, নাকি অপারগতার, তা বোঝা দায়। ওদের মাঝখানে মাত্র এক হাত দূরত্ব, অথচ মনে হচ্ছে কয়েক আলোকবর্ষের ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে।
পূর্ণিমা মুখ তোলে না। মাটির দিকে তাকিয়েই শান্ত গলায় বলে, “বাস্তবতা ছন্দের মাপে চলে না প্রিয়। জীবনের অঙ্কটা বড্ড কঠিন, সেখানে আবেগের ভগ্নাংশগুলো কখনোই মেলে না। আমরা যা চাই, তা যদি পেতাম, তবে ‘দীর্ঘশ্বাস’ শব্দটা অভিধানে থাকত না।”
“কাঁচের মতো স্বপ্ন ছিল, ভাঙল নিঠুর হাতে,
বিষাদে রাঙা স্মৃতিগুলো জাগবে প্রতি রাতে।
ভুলতে তোমায় পারব না গো, মিথ্যে কেন বলি? তোমার দেওয়া ক্ষতেই আমি নিজের চিতায় জ্বলি।”
প্রিয়র এই কথাগুলো যেন বাতাসে ভাসতে ভাসতে পূর্ণিমার হৃৎপিণ্ডে গিয়ে বিঁধল। পূর্ণিমা এবার তাকায়। সেই দৃষ্টিতে কোনো অভিযোগ নেই। আছে এক তীব্র হাহাকার, যা কোনো শব্দ দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। মনে হচ্ছে, সদ্য শ্রাবণের মেঘ জমেছে তার চোখে, কিন্তু বর্ষণ নামছে না। এই দৃষ্টি যেন এক ভাঙা আয়না, যেখানে প্রিয় নিজের ছিন্নভিন্ন প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছে। পরিবেশটা ভারী হয়ে উঠছে, আশেপাশের কোলাহল যেন এই দুটি মানুষের একান্ত বিষাদের কাছে ম্লান হয়ে গেছে।
পূর্ণিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বাতাসের সাথে মিশে সেই শ্বাসটা যেন বলে যায় অনেক না বলা কথা। সে আলতো করে বলে, “স্মৃতি তো মানুষের ছায়া, প্রিয়। চাইলেও তাকে মুছে ফেলা যায় না। কিন্তু জানো তো? কিছু গল্প অসমাপ্ত থাকলেই সুন্দর। সব পূর্ণতা সুখের হয় না। আমাদের এই না-পাওয়াটুকু আজীবন অক্ষত থাকুক। ওটাই হয়ে থাক আমাদের আসল প্রাপ্তি।”
“এক শহরেই থাকব দুজন, আকাশ হবে ভিন্ন,
বুকের ভেতর জমিয়ে রাখব প্রেমের পোড়া চিহ্ন।”
শেষ শায়েরিটা আউড়ে প্রিয় উঠে দাঁড়ায়। পূর্ণিমাও ওঠে। কেউ কাউকে ‘বিদায়’ বলে না, ‘ভালো থেকো’ বলে না। শুধু দুজনের ছায়া মাটিতে কিছুক্ষণ পাশাপাশি দীর্ঘ হয়, তারপর মিলিয়ে যায়। প্রিয় হাঁটা শুরু করে উত্তরের রাস্তায়, পূর্ণিমা দক্ষিণের। ব্যস্ত সময়ের এই মোড়ে এসে কোনো নাটকীয় কান্না নেই, কোনো পিছু ডাক নেই। দুই বুকভরা শূন্যতার দুঃসহ ভার বয়ে নিয়ে জনস্রোতে হারিয়ে গেল প্রিয় এবং পূর্ণিমা।