বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতার ইতিহাস নানাভাবে নানান শিল্প মাধ্যমে উঠে এসেছে। কখনো কবিতায়, কখনো গানে, কখনোবা উপন্যাস, নাটক আবার কখনো চলচ্চিত্রে। শিল্প মাধ্যমের নানান শাখায় বিভিন্ন সময়ে ফুটে উঠেছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তর-পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সবচেয়ে সহজ পন্থায় ও সহজবোধ্যভাবে চলচ্চিত্রশিল্প
মাধ্যমের সাহায্যে পৌঁছায়। বাংলাদেশের গুণী নির্মাতারা বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেছেন, এখনো করছেন। এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু নির্মিত ‘গেরিলা’। সৈয়দ শামসুল হক রচিত ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘গেরিলা’। সিনেমাটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ সুনাম অর্জন করেছিল। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১১ তে গেরিলা ৯টি বিভাগ থেকে পুরস্কৃত হয়। সাম্প্রতিককালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমাগুলোর মধ্যে গেরিলাকে সবচেয়ে বেশি সুনির্মিত ছবি বলে মনে হয়। একই সঙ্গে শহুরে ও গ্রামীণ পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র ফুটিয়ে তোলা খুব কম সিনেমাগুলোর মধ্যে গেরিলা একটি। ছবিটির জনপ্রিয়তা সম্ভবত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা, পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা- নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন-অগ্নিসংযোগ, মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের বীরোচিত যুদ্ধদৃশ্যের রুপালি পর্দায় বাস্তব রূপায়ণের কারণে। বাঙালির মহাকাব্যিক যুদ্ধের একটা চিত্রভাষ্য হয়তো মানুষের মন ছুঁয়ে গেছে।
‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রে তসলিম সর্দারের চরিত্রে প্রয়াত অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামানের ধ্রুপদী অভিনয় কদাচিৎ আমরা সাক্ষাৎ পাই আমাদের চলচ্চিত্রে। তিনি মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, ‘আমি ৩৫০টির মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি, কিন্তু গেরিলাতে অভিনয় করে যে তৃপ্তি আমি পেয়েছি তা অন্য কোনো ছবিতে পাইনি।’ জয়া আহসান তুঙ্গস্পর্শী অভিনয় করেছেন গেরিলায়। মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস, চরিত্রের প্রতি অন্বিষ্টতা, ভালোবাসা, শুটিংয়ে সীমাহীন পরিশ্রম ও মেধার ব্যবহারে জয়া হয়ে উঠেছিলেন ১৯৭১-এর বিলকিস। ব্যক্তি জয়া ও অভিনয়ে চরিত্র বিলকিসের অদ্বৈত হয়ে ওঠা এ চলচ্চিত্রে প্রায় বিরল ঘটনা। জয়া হয়ে উঠেছিলেন গেরিলা চলচ্চিত্রের প্রাণ। সঙ্গে যে অভিনেতা সমানতালে গেরিলাকে নিয়ে গেছেন ’৭১-এর বাস্তবতার গভীরে তিনি হচ্ছেন শতাব্দী ওয়াদুদ। পাকিস্তানি মেজর সরফরাজ ও ক্যাপ্টেন শামসদের চরিত্রাভিনয়ের গভীরতা ও নিষ্ঠুর আচরণ মানুষের কাছে তাকে ঘৃণিত ব্যক্তি করে তুলেছিল। অতিথি শিল্পী হিসেবে হাসানের চরিত্রে ফেরদৌসের পরিমিত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
এ ছবির নির্মাতা নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বলেন, দুই বছরের দিবারাত্রি নিদ্রাহীন, শিল্পের জটিল পথে ঘাম ঝরিয়েছেন হাজারো শিল্পী-কলাকুশলী এবং শহর ও গ্রামের সাধারণ মানুষ। রেলগাড়ির দৃশ্যের জন্য ষাটের দশকের পরিত্যক্ত বগি ও ইঞ্জিন মেরামত এবং সচল করে পাকিস্তানি রেলের রূপ দিতে দুই মাসেরও অধিক সময় রেল কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আমাদের শিল্প নির্দেশনা বিভাগের প্রাণান্তকর পরিশ্রম। শুটিংয়ের সময় একাধিক দিন সব রেল সময়সূচি বিলম্ব করে শুটিং সম্পন্ন করার জন্য সাধারণ যাত্রীদের অবিশ্বাস্য সহযোগিতা ভোলার মতো নয় বলে উল্লেখ করেন নির্মাতা। তার কথায় বিলম্বের জন্য বিরক্ত হওয়ার পরিবর্তে আমাদের রেলগাড়ি দেখলে সাধারণ যাত্রীরা ‘গেরিলা’ ‘গেরিলা’ বলে চিৎকার করে ও তালি দিয়ে আমাদের স্বাগত জানাত, অভিনন্দিত করত। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মানুষের এ ভালোবাসা ও আবেগ এক যুগের বেশি সময় পরও আমাকে অশ্রুসজল করে। পার্বতীপুর, দিনাজপুর, রংপুর, তিস্তা ও কাউনিয়ার রেলস্টেশনের অপূর্ব স্থাপত্য ও প্রকৃতি যেমন গেরিলার চিত্রভাষ্যে স্থান পেয়ে গেছে তেমনি অত্র এলাকার সাধারণ মানুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আমদের মানসপটে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছে। যুদ্ধদৃশ্য বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চৌকশ পদাতিক বাহিনীর সদস্য, ট্যাংক বাহিনী ও আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের দিনের পর দিন অমানসিক পরিশ্রমের কথা ভুলব কেমন করে। যুদ্ধদৃশ্যে ব্যবহৃত সব অস্ত্র, গুলি ও বিস্ফোরক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনী তাদের নিয়ম এবং বিধি মেনে আমাদের কাজে ব্যবহারে সুযোগ দিয়েছে। কতটুকু মুক্তিযুদ্ধপ্রেমী ও দেশপ্রেমী মানুষ হলে সে সময়ের কর্তৃপক্ষ এ ধরনের সহযোগিতার হাত বাড়ান। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। কর্নেল সাজ্জাদ মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রাভিনেতাদের মুক্তিবাহিনীর কৌশলসমূহ প্রশিক্ষণ দিয়ে অভিনেতা তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন। নরসিংদী, সোনারগাঁ, ধামরাই হয়ে উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় চিত্রগ্রহণ বাংলাদেশের মানুষ, গ্রাম, শহর, নদী, বৃক্ষ, তৃণলতা, প্রাণিকূল, ঐতিহ্যের এক ও অভিন্ন দৃশ্যচিত্র এখন কালের সাক্ষী। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাস শর্তহীন চলচ্চিত্রায়ন করার অনুমতি দিয়ে আমাকে চিরঋণী করে গেছেন।