‘বিগত কয়েক বছর ধরে চিৎকার আর আবেদন করে যাচ্ছি যৌথ নীতিমালার নতুন শর্ত বাতিল বা শিথিলের জন্য, কিন্তু চলচ্চিত্রের উন্নয়নে সরকারের আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাচ্ছি না। আশ্বাসে বিশ্বাস করে চলতে গিয়ে স্বপ্ন পূরণ তো হচ্ছেই না, উপরন্তু চলচ্চিত্রশিল্প দিনের পর দিন ধ্বংসই হয়ে যাচ্ছে।’ এমন আক্ষেপ একজন চলচ্চিত্র প্রযোজকের। চলচ্চিত্র নির্মাণে যৌথ প্রযোজনার নীতিমালার একটিমাত্র শর্তের কারণে আটকে গেছে যৌথ আয়োজনের ছবি নির্মাণ। অশ্লীলতা, নকল ও পাইরেসির কারণে নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে যখন চলচ্চিত্র ব্যবসায় ধস নামে তখনই ২০১৪ সালে যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ সিনেমা হলে দর্শক ফিরিয়ে আনে। ছবিটি কলকাতার সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয়। এরপর যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণে নির্মাতারা আগ্রহী হয়ে ওঠেন ও সিনেমা শিল্পে প্রাণ ফিরে আসে। নির্মাণ হতে থাকে ‘শিকারি’, ‘বাদশা’, ‘নবাব’, ‘চালবাজ’, ‘ভাইজান এলোরে’, ‘ব্ল্যাক’, ‘রোমিও ভার্সেস জুলিয়েট’সহ অনেক ছবি। এসব ছবি দেখতে সিনেমা হলে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় হয়েছিল। কিন্তু সরকার যখন ২০১৭ সালে যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা সংশোধন করে এতে নতুন একটি শর্ত যুক্ত করে দেয়, তখনই বাধে বিপত্তি। এই শর্তের ঙ-এর ০২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সাধারণভাবে যৌথ চলচ্চিত্র প্রযোজনার ক্ষেত্রে প্রধান চরিত্রের অভিনয়শিল্পী এবং মুখ্য কারিগরি কর্মীসহ শিল্পী ও কলাকুশলী, লোকেশন সমানুপাতিক হারে নিয়োগের বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।’ নির্মাতা অনন্য মামুন আক্ষেপ করে বলেন, এই ধারায় ‘সমানুপাতিক’ শব্দটি পরিষ্কার নয়। কারণ যদি এখান থেকে মেইন কাস্ট নেওয়া হয় তাহলে গল্পের প্রয়োজনে অন্য পক্ষের দেশ থেকে পাঁচজন বড় আর্টিস্ট নিতে হবে। মানে এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে গল্প। গল্প কোন দেশ
থেকে কতজন শিল্পী বা লোকেশন চায় সেটিই মূল কথা। সরকার শুধু অফিশিয়াল কাগজ দেখে, গল্প কী চায় সেটি বিবেচনায় নেয় না। তা ছাড়া নির্মাতাদের মতামত না নিয়েই নীতিমালা তৈরি ও সংশোধন করে। এটিও যৌথ প্রযোজনার নির্মাণের ক্ষেত্রে বড় একটি অন্তরায়। এ নিয়মের অবসান চাই। প্রযোজক সমিতির সাবেক কর্মকর্তা কামাল কিবরিয়া লিপু বলেন, সরকার ও চলচ্চিত্রের সবাইকে অনুরোধ জানিয়ে বলব, দেশীয় চলচ্চিত্রের উন্নয়নের স্বার্থে আবার যাতে যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ বজায় রাখা যায় সেজন্য সবাইকে উদারনীতি গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো বাধা রাখা যাবে না। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্রশিল্পে যে অচলাবস্থা চলছে তাতে করে বিগ বাজেট ও অ্যারেঞ্জমেন্টের ছবি আমাদের একার পক্ষে নির্মাণ সম্ভব নয়। আর মানসম্মত ছবি না পেলে কখনই সিনেমা হলে দর্শক ফেরানো যাবে না। যৌথ আয়োজনের ছবি নির্মাণ হলে উন্নত বাজেট ও অ্যারেঞ্জমেন্টের কারণে তা সহজেই দর্শক নজর কাড়তে পারবে। চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, পৃথিবীর কোথাও যৌথ প্রযোজনার নীতিমালায় এমন ধরাবাধা নিয়ম নেই। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া বা কানাডার কথাই যদি বলি তা হলে বলতে হয়, তারা ঐকমত্যের ভিত্তিতে মানে দুই দেশের নির্মাতারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শিল্পী-কলাকুশলী নির্ধারণ করেন। ওইসব দেশের সরকারের ক্ষেত্রে এসব মূল বিষয় নয়, তাদের কাছে বিনিয়োগটাই মুখ্য। অথচ আমাদের দেশে ২০১২ সালের নীতিমালায়ও অন্য দেশের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে আমরা ভালোভাবে কাজ করে আসছিলাম। ২০১৭ সালের নীতিমালায় এমন বাধ্যতামূলক শর্ত আরোপের ফলে জাজ মাল্টিমিডিয়া কলকাতার সঙ্গে এই নীতিমালা প্রণয়নের আগে কাজ শুরু করা ‘নূরজাহান’, ‘বেপরোয়া’, ‘ককপিট’ ছবি তিনটি মুক্তি দিতে বাধার মুখে পড়ে এবং পরে এগুলো ভারতীয় ছবি হিসেবে আমদানি করতে বাধ্য হয়। এই ক্ষতিকর শর্ত বাতিল না হলে সরকার চলচ্চিত্রের উন্নয়নে যতই অনুদান আর প্রণোদনা দিক না কেন তাতে কোনো সুফল আসবে না। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে যৌথ প্রযোজনার এই নতুন নীতিমালা প্রণয়নের পর একটিমাত্র শর্তের কারণে আটকে গেছে যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ। ২০১৮ সালে ‘বালিঘর, ‘প্রেম আমার টু’ ও ‘সুলতান : দ্য সেভিয়ার’ নামে যৌথ প্রযোজনার তিনটি ছবির চিত্রনাট্য অনুমোদন পায়। 
পরে ‘প্রেম আমার টু’ ও ‘সুলতান : দ্য সেভিয়ার’ ছবি দুটি নতুন নীতিমালায় নির্মাণে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত কলকাতার একক ছবি হিসেবে তৈরি হয়। আর ‘বালিঘর’-এর কাজ বাতিল হয়। ছবিটির পরিচালক অরিন্দম শীল সে সময় জানিয়েছিলেন, নতুন নীতিমালার জটিল প্রক্রিয়ার কারণে ‘বালিঘর’ নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে না। প্রযোজকদের অনেকে মনে করেন, শুটিং চলাকালে গল্পের প্রয়োজনে লোকেশন থেকে শুরু করে অনেক কিছুই পরিবর্তন করতে হতে পারে। ফলে এরকম কঠোর নিয়ম মেনে সৃজনশীল কাজ করা প্রায় অসম্ভব। ‘প্রযোজক সমিতির সাবেক সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু বলেন, ‘আমরা এক মিটিংয়ে বিগত সরকারের তথ্যমন্ত্রীকে বিষয়টি নতুন করে বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছিলাম।
তিনি কথা দিয়েছিলেন একটি কমিটি গঠন করে যাচাই-বাছাই করে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই হয়নি।’ খসরু জানান, সংশোধিত এই নীতিমালা মেনে দুই দেশের কোনো প্রযোজকই কাজ করতে আগ্রহী নন। যারা এক সময় নীতিমালায় পরিবর্তন চেয়েছিলেন, তারাই এখন বলছেন সংশোধনের পর নীতিমালা কঠিন হয়ে গেছে। অথচ কয়েক বছর আগে যৌথ প্রযোজনার ছবির কারণে বেশ চাঙা হয়ে উঠেছিল চলচ্চিত্রাঙ্গন। নীতিমালা নমনীয় হলে আবারও যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণ বাড়বে। ফিরে আসবে দেশীয় চলচ্চিত্রের প্রাণ।