শোবিজ দুনিয়ায়, বিশেষ করে চলচ্চিত্র জগতে কাজের বাজার মন্দা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ফলে কাজ নেই তাই অলস সময় কাটাতে হচ্ছে অধিকাংশ তারকাকে। আর এই অলস সময় কাটাতে গিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে তাঁরা বেছে নিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এতে এই খাত থেকে আয়ও করছেন অনেক তারকা। মানে তাঁদের আয়ের পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুক আর ইউটিউব চ্যানেল। ব্যক্তিগত বিষয় বা শোবিজ দুনিয়া এবং মাঝে মধ্যে নিজেদের কাজের খবর নিজেরাই ফেসবুকে পোস্ট করে থাকেন তাঁরা। মানে ফেসবুকেই সরব এখন তারকারা। অনেকে বলছেন, অনেক তারকাই নিজের কাজ নিয়ে যতটা না ব্যস্ত, তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এমন তারকার সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। নিজের ছবি দিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন অনেক তারকা। পাশাপাশি বিভিন্ন কাজের কথাও ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। এ ছাড়া নায়িকারা আবেদনময়ী ছবি পোস্ট করে আলোচনায় থাকার চেষ্টা করছেন। চলচ্চিত্রের প্রচারেও অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছেন। অনেক তারকার ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টগুলোতে প্রবেশ করলে পুরো ইন্ডাস্ট্রির খবর মেলে। তারকাদের অ্যাকাউন্টগুলো খবরের সূত্রও হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। শুধু তা-ই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দিয়ে সিনেমা ও নিজের প্রচারের পাশাপাশি আয়ও করছেন তারকারা। বাংলাদেশে এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্রের অবস্থা সংকটজনক। অনেক সময় সিনেমা মুক্তি পেলে তার খবরও পাওয়া যায় না। কারণ এখনকার চলচ্চিত্র নির্মাতারা চলচ্চিত্রের প্রচারবিমুখ হয়ে পড়েছেন। এরই প্রেক্ষাপটে তারকারা ফেসবুক পেজ, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামে তাঁদের ছবি এবং কাজের কথা প্রচার করছেন। জয়া আহসান, শাকিব খান, নুসরাত ফারিয়া, বিদ্যা সিনহা মিম, আরিফিন শুভ, শবনম বুবলী, পরীমণি, সিয়াম আহমেদ, প্রভা, পূজা চেরী, রোশানসহ অনেকেই ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামে সব সময় সরব থাকেন। কেউ কেউ ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামে নিজের ছবির শুটিং, ফার্স্ট লুকসহ নানা খবর দিয়ে থাকেন। ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রাম- তিন মাধ্যমেই সরব অভিনয়শিল্পী বিদ্যা সিনহা মিম। মিম বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় আমাদের অনেক বন্ধু ও ভক্ত অনুসারী আছেন। তারা আমাদের পোস্টগুলো দেখেন। আমাদের এই পোস্টগুলোর মাধ্যমে ছবির খবর তাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি। এত সংখ্যক অনুসারীর কাছে আমাদের খবরগুলো যাচ্ছে, এটা একটা বড় ব্যাপার।’ ছবির প্রচার ও নিজেকে আলোচনায় রাখার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বুবলী। তিনি বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির পরিবর্তন হচ্ছে। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসার ফলে নিজের প্রচার নিজেই করা যায়। এ ছাড়া তারকাদের অনেকে ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামে বেশ অ্যাকটিভ থাকেন।’ নুসরাত ফারিয়ার কাছে এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুবই শক্তিশালী। তিনি বলেন, ‘শুধু দেশের মধ্যেই নয়, মুহূর্তে দেশের বাইরের সব মানুষকে একটা পোস্টের মাধ্যমেই জানিয়ে দেওয়া যায় সব কিছু। শুটিংয়ের জন্য নানা সময়ে দেশের বাইরে যাই। সেখান থেকে একটা পোস্টের মাধ্যমেই আমার ছবির খবর জানাতে পারি। এটা এত সহজ একটা মাধ্যম, যে কোনো জায়গা থেকেই পৃথিবীর সবার কাছে ছবির খবর পৌঁছানো যায়।’ শাকিব খান বলেন, ‘এখন সব কিছু ডিজিটালি এগোচ্ছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো প্রচারে বড় ভূমিকা রাখছে।’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেমন খুব সহজভাবে একজন তারকা তার প্রচার করতে পারেন, তেমনি আবার যে কেউ এখানে সহজে লিখতে পারছেন বলে অনেক সময় বিপত্তিও ঘটছে। একটা ছবি নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় যাচ্ছেতাই ভাষা ব্যবহার করে লেখালেখি করা হয়। এটা ঠিক নয়। এটাকে গঠনমূলক ও সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানো উচিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের ভালো-খারাপ মুহূর্ত, পুরোনো স্মৃতি শেয়ার করেন অনেক তারকা। উদাহরণ হিসেবে জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী ও তাসনিয়া ফারিণের ফেসবুক পোস্ট তুলে ধরা হলো এখানে- গত বছর জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী কালো পোশাকে বেশ কিছু হাস্যোজ্জ্বল ছবি ফেসবুকে শেয়ার করেছেন। ক্যাপশনে লিখেছেন- ‘কিছু খেতে, কোথাও থাকার জন্য, আমার নিজের বলে কিছু মানুষ, মিস করার মতো কাউকে, জীবন কি এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে?’ গত বছর নিউইয়র্ক ঘুরতে যান অভিনেত্রী তাসনিয়া ফারিণ। ভ্রমণের কিছু ছবি পোস্ট করেন তিনি তাঁর ফেসবুক পেজে। গত বছর ‘তুফান ছবির মুক্তির পর নায়ক শাকিব খান ও কণ্ঠশিল্পী কণার একটি ছবি পোস্ট করে তাঁদের শুভ কামনা জানান অভিনেত্রী অপু বিশ্বাস।’ আসলে ডিজিটাল যুগে মিডিয়া তারকারা শুধু টেলিভিশন, সিনেমা বা নাটকে অভিনয় করেই থেমে থাকছেন না। তাঁরা নিজেদের পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা বাড়াতে ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব, টুইটার এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় হচ্ছেন। অভিনয়, গান কিংবা নাচের পাশাপাশি এখন নিজেরাই তৈরি করছেন ভিডিও কনটেন্ট, যা সরাসরি দর্শক-ভক্তদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। তারকারা নিজেরাই হয়ে উঠেছেন কনটেন্ট ক্রিয়েটর। তাঁরা নিজস্ব ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল, টিকটক অ্যাকাউন্ট চ্যানেল খুলে তুলে ধরছেন নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ, কাজের গল্প, এমনকি ব্যক্তি জীবনের বিভিন্ন দিক। ফেসবুকে রিলস, টিকটকে ছোট ছোট ভিডিও প্রকাশ করছেন তারকারা। মিলিয়ন মিলিয়ন ভক্ত তাঁদের। বিষয়টি শুধু আত্মপ্রচারণা নয়, বরং ডিজিটাল মিডিয়ার এক নতুন বাস্তবতা, যেখানে তারকারাও নিজের ব্র্যান্ড তৈরি করছেন। অন্যদিকে তাঁরা নিজের কাজের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনকেও ভাগ করে নিচ্ছেন। যা আগের সময়ে ছিল কল্পনাতীত। তারকাদের কাছে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক, যেখানে তাঁরা নানা সময়ের, মুহূর্তের, কাজের-অকাজের আপডেট দিয়ে থাকেন। কোনো বিষয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত মতামত, বিশেষ কিছু নিয়ে লেখা বা দেশের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ছবিসহ পোস্ট করে থাকেন। কেউ কেউ নিজেরাই মজার মজার ভিডিও বানিয়ে তাঁদের ফেসবুক অফিশিয়াল পেজ, ইউটিউব চ্যানেলে দিয়ে দিচ্ছেন। কেউ আবার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন নানারকম ভিডিওতে। কারও কারও ভিডিওতে দেখা গেছে, কাজের পেছনের গল্প কিংবা দেশে-বিদেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। কেউ কেউ নাটক বা সিনেমার প্রচারণায় ব্যবহার করছেন সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম ও ইউটিউব আর টিকটক। এই সময়ে নবীন-প্রবীণ বেশির ভাগ সেলেব্রিটিই ব্যস্ত সোশ্যাল সাইট ফেসবুকে। হাতে গোনা কয়েকজন আছেন যাঁরা ফেসবুক ব্যবহার করেন না। আর ইদানীং নিজেদের কাজ, গান বা নানারকম কনটেন্ট তৈরি করে ইউটিউব চ্যানেলে দিচ্ছেন কোনো কোনো তারকা। একটা সময় পর্যন্ত তারকারা মিডিয়া কভারেজ, টিভি অনুষ্ঠান, পত্রিকার সাক্ষাৎকার কিংবা পাবলিক ইভেন্টের মাধ্যমেই নিজেদের তুলে ধরতেন। কিন্তু বর্তমান যুগে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও সোশ্যাল মিডিয়া একটি স্বাধীন এবং সরাসরি প্রচারণার জায়গা করে দিয়েছে। এখানে তাঁরা নিজের ইচ্ছামতো কনটেন্ট বানাতে পারেন, সম্পাদনা করতে পারেন এবং সরাসরি প্রতিক্রিয়া পেতে পারেন দর্শকদের কাছ থেকে।
আরও বড় বিষয় হলো- এসব প্ল্যাটফর্ম শুধু প্রচারণার মাধ্যম নয়, বরং এটি একটি আয়ের উৎস হিসেবেও বিবেচিত। গুগল অ্যাডসেন্স, স্পন্সরশিপ, ব্র্যান্ড কলাবোরেশন, সব মিলিয়ে তারকাদের জন্য একটি লাভজনক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে এসব।
যদিও এই প্ল্যাটফর্মে তারকারা দিনদিন আগ্রহী হচ্ছেন, তবে কনটেন্টের মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। অনেকেই পেশাদার ভিডিও বানালেও, কিছু তারকার ভিডিও পরিকল্পনাহীন, তাড়াহুড়া করে বানানো কিংবা শুধুই ব্র্যান্ডিংয়ের উদ্দেশ্যে তৈরি। এ থেকে দর্শকের বিরক্তি তৈরি হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে।