নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের কথা। শীতের সকালের কোমল রোদ গায়ে মেখে যখন মুন্সিগঞ্জের বজ্রযোগিনীর পুকুরপারের দিকে এগোই, চোখে পড়ে খেত ভরা সবুজের উচ্ছ্বাস। শাকসবজির পাতায় জমে থাকা শিশিরকণা আর কৃষকের সকালের ব্যস্ততা যেন বলে দিচ্ছিল, এ গ্রামের মাটিতে এখন চলছে নীরব পরিবর্তন। রাসায়নিকনির্ভর কৃষির গণ্ডি থেকে বেরিয়ে জৈবকৃষির দিকে পা বাড়াচ্ছেন এখানকার কৃষক। সেই পরিবর্তনের যাত্রাপথ, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার গল্পই আপনাদের শোনাতে চাই।
বহুদিন ধরেই দেশের কৃষিতে সাধারণ চিত্র দেখা যায়, বেশি ফলনের আশায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার। কিন্তু তারই দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি এখন কৃষক উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। মাটির উর্বরতা কমে আসা, উৎপাদনখরচ বৃদ্ধি, মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি এসবই আজ তাদের ভাবনার বিষয়।
পুকুরপারের কৃষি মাঠজুড়ে কৃষকের কর্মব্যস্ততা। চলছে শীতের সবজি তুলে বাজারে নেওয়ার প্রস্তুতি। এগোতেই এক কৃষক এগিয়ে এলেন, তাঁর নাম সিরাজ খান। কথা বলি তাঁর সঙ্গে। প্রশ্ন করি, ‘আপনারা নাকি আইপিএম ক্লাব করেছেন, জৈবকৃষির চর্চা করছেন?’ সিরাজ খান জানালেন, ‘আগে কীটনাশক ছাড়া চাষাবাদ চিন্তাই করতাম না। কিন্তু তিন-চার বছর ধরে দেখি, মাটির জো কমছে, রোগও বাড়ছে। পরে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা আমাদের জৈব পদ্ধতি দেখালেন। নিজের চোখে ফল দেখে এখন আর পুরোনো পথে ফিরতে ইচ্ছে হয় না।’
সিরাজ খানের জমিতে এখন সার হিসেবে ব্যবহৃত হয় পচা গোবর, ঘরে তৈরি বায়োসলারি, নিমপাতার নির্যাস, ফারমেন্টেড জৈব তরল সার। কীট দমনের জন্য আছে ফেরোমন ট্র্যাপ, হলুদ স্টিকি ট্র্যাপ, আলো ফাঁদ, যা আইপিএম বা সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার প্রধান উপাদান।
মাঠেই আরেক খেতে কাজ করছিলেন গ্রামের আইপিএম ক্লাবের সভাপতি নুরুল ইসলাম। তিনি বললেন, ‘আমি ২০১৭ সালে প্রথম আইপিএম প্রশিক্ষণ নিই। তখন বুঝলাম রাসায়নিক কম ব্যবহার করেও ফসল রক্ষা করা যায়। ফেরোমন ট্র্যাপ লাগানোর পর দেখি পোকা নিজেরাই ধরা পড়ছে। এখন আমাদের ক্লাবের সদস্য কৃষক নিয়মিত জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করছেন।’
আইপিএম শুধু পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণই করে না, জমির জৈবকাঠামো অক্ষুণ্ন রাখে, খরচ কমায়, পরিবেশ রক্ষা করে। নুরুল ইসলাম মনে করেন, এই পদ্ধতির সম্প্রসারণই ভবিষ্যতের টেকসই কৃষির ভিত্তি।
বজ্রযোগিনীর আরও এক কৃষক মফিজ খান বললেন, ‘এখন আমরা শুধু ফসল ফলাই না, কীভাবে নিরাপদভাবে খাবার উৎপাদন করতে হয় সেটা শিখছি। জমিতে কাজ করার নিয়ম, সেচব্যবস্থা, সার প্রয়োগ সবই গ্যাপ অনুসরণ করে করার চেষ্টা করছি।’
শুনে খুব ভালো লাগল। প্রত্যন্ত গ্রামের একজন কৃষক গ্যাপের কথা বলছেন। GAP-এর পূর্ণরূপ Good Agricultural Practices, বাংলায় উত্তম কৃষি অনুশীলন। এটি হলো কৃষিক্ষেত্রে এমন একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদণ্ড ও নির্দেশনা, যার মাধ্যমে নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত, পরিবেশবান্ধব এবং বাজারযোগ্য কৃষিপণ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা হয়। সহজ কথায় গ্যাপ মানে, ভালো, সঠিক, পরিচ্ছন্ন, বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ।

গ্যাপ মেনে চললে কীটনাশক, সার, হরমোন- এসবের ব্যবহার নির্দিষ্ট নিয়মে হয়। এতে খাদ্যে ক্ষতিকর অবশিষ্টাংশ কমে যায়। ভোক্তার জন্য খাবার হয় নিরাপদ। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ সব জায়গায় কৃষিপণ্য রপ্তানির আগে গ্যাপ সার্টিফিকেশন চাওয়া হয়। তাই গ্যাপ না মানলে বিদেশে ফল, সবজি, ধান বা ফুল রপ্তানি করা কঠিন। গ্যাপ নির্দেশনায় মাটির নিয়মিত পরীক্ষা, সুষম সারের ব্যবহার, জৈব পদার্থ সংযোজন বাধ্যতামূলক। এতে মাটির উর্বরতা বজায় থাকে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ে। নির্দিষ্ট পরিমাপে পানি ব্যবহার, ড্রিপ/স্প্রিংকলারসহ আধুনিক সেচ প্রযুক্তির ব্যবহারের পরামর্শ দেয়। এতে পানির অপচয় কমে। গ্যাপ অনুযায়ী কীটনাশক বাছাই ও প্রয়োগে সতর্কতা থাকে, উপকারী পোকা রক্ষা করা হয়, বিষমুক্ত পদ্ধতির ব্যবহার বাড়ানো হয়। এতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বাঁচে। গ্যাপ পরিকল্পনায় রয়েছে নিরাপদ বীজ/চারা, পরিচ্ছন্ন জমি, ফসল পর্যায়ক্রমিকতা এবং সময়মতো মাঠ পর্যবেক্ষণ। এতে রোগ-পোকা লাগার ঝুঁকি কমে। সবচেয়ে বড় কথা, সার-কীটনাশক-সেচ সবই নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহৃত হয়। ফলে অপচয় কমে, খরচ সাশ্রয় হয়, আর উৎপাদন হয় গুণগতমানসম্পন্ন, যা ভালো দামে বিক্রি হয়। যা হোক, বজ্রযোগিনী গ্রামের জৈবকৃষির সঙ্গে কৃষককে যুক্ত করার মূল নায়ক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. সেলিম হোসেন। কথা বলি তাঁর সঙ্গে। তিনি জানান, ‘আসলে কৃষক খুবই আগ্রহী। শুধু সঠিক পথটা দেখিয়ে দিতে হয়। জৈবসার, ফেরোমন ট্র্যাপ, নিম এক্সট্রাক্ট এসব তাঁরা নিজেরাই বানাতে পারেন। এতে খরচ কমে, ফলনও স্থিতিশীল থাকে। সবচেয়ে বড় কথা, মাটির শক্তি ফিরে আসে।’
তাঁর ভাষায়, জৈবকৃষি কোনো ‘ফ্যাশন’ নয়, বরং একটি প্রয়োজনীয় সমাধান, যা দেশের খাদ্যব্যবস্থাকে আরও নিরাপদ করতে পারে। আইপিএম ও জৈবসারের ব্যবহার কৃষকের উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে।
পুকুরপারের কৃষক আওয়াল বলেন, ‘আগে সিজনে ১৫-১৮ হাজার টাকা শুধু কীটনাশকে যেত। এখন তার অর্ধেকও লাগে না। ফসল ভালো থাকে, জমিও সুস্থ থাকে।’
জৈবসারের অন্য সুবিধা হলো মাটির পানি ধারণক্ষমতা বাড়ে, জমির গঠন উন্নত হয় এবং পরবর্তী মৌসুমে কম সার লাগে। সবজি সংগ্রহ করে সকাল সকাল বাজার ধরতে ছুটছেন কৃষক। কারণ পুকুরপারের সকালবেলার বাজার মাত্র কয়েক ঘণ্টা থাকে। কৃষক ইসমাইল শেখ বলেন, ‘জৈব সবজির চাহিদা এখন অনেক। ক্রেতারা স্বাদ আর তাজা সবজি কিনতে আসেন। তাই সকালে বাজার মিস করলে ক্ষতি হয়।’
বাজারে দাঁড়িয়ে লক্ষ করলাম, জৈব ও রাসায়নিক সারে উৎপাদিত সবজির মধ্যে পার্থক্য বোঝাতে কৃষক নিজেরাই কিছু চিহ্ন ব্যবহার করছেন। যেমন ফুলকপির ক্ষেত্রে জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত কপির পাতার রং ও গায়ে দাগ আলাদা, যা রাসায়নিক ব্যবহৃত কপির তুলনায় স্বাভাবিক। এক কৃষক ফুলকপি দেখিয়ে বললেন, ‘দেখেন এটা জৈবসারে চাষ করা, এটা কেমন টাইট। আর ওইটা রাসায়নিক সার ব্যবহার করে। এটা ওটার মতো টাইট না।’
সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে পাইকারি সবজি বাজারের কর্মব্যস্ততা প্রায় শেষ। তবু কথা হলো এক পাইকারি ক্রেতার সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘জৈব সবজির আলাদা ক্রেতা আছে। দাম একটু বেশি হলেও মানুষ খেতে চায় নিরাপদ খাবার। আমাদেরও লাভ থাকে।’
এই প্রবণতায় বোঝা যায়, বাংলাদেশের কৃষি বাজারে নিরাপদ খাদ্যের স্থায়ী চাহিদা তৈরি হয়েছে। দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষকের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু এখনো নানা ঝুঁকি, পোকামাকড়ের আক্রমণ, অনাবৃষ্টি-বন্যা, বাজারদরে অস্থিরতা- এসব কৃষককে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। আর এসব সংকটে সুযোগ নেয় কিছু অসাধু কীটনাশক ব্যবসায়ী, যারা অযৌক্তিক পরামর্শ দিয়ে কৃষকের ক্ষতি করে।
এমন পরিস্থিতিতে জৈবকৃষি ও আইপিএম ব্যবহার পরিবেশবান্ধব চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষকের অর্থনৈতিক সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে পারে। একবারে পুরোপুরি জৈবকৃষিতে ফিরে যাওয়া কঠিন। কিন্তু ধীরে ধীরে তা শুরু করা সম্ভব, যেমনটা বজ্রযোগিনীতে ঘটছে। প্রথমে রাসায়নিকের ব্যবহার অল্প কমানো, পরে জৈবসার যোগ করা, ফেরোমন ট্র্যাপ ব্যবহার, সর্বশেষ গ্যাপ অনুসরণ- এই ধাপগুলো অনুসরণ করলে কৃষকের ক্ষতি হয় না, বরং সামনে এগোনোর প্রেরণা বাড়ে।
বজ্রযোগিনীর কৃষকরা দেখিয়ে দিয়েছেন, ইচ্ছাশক্তি, সঠিক দিকনির্দেশনা আর সামান্য উদ্যোগ নিয়েই বদলে দেওয়া যায় একটি গ্রাম। দেশ যদি কৃষিতে টেকসই পথ খুঁজে নিতে চায়, তবে বজ্রযোগিনীর মতো জৈবকৃষি গ্রামগুলোই হতে পারে ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা।
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব
shykhs@gmail.com