চিকিৎসাকে একসময় বলা হতো মানবসেবার শ্রেষ্ঠ পেশা। একসময়ের সেই মহত্তম ব্রত আজ নানা বিতর্ক, অনিয়ম ও বাণিজ্যিকীকরণের অভিযোগে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষ প্রায়ই অভিযোগ তোলেন অধিকাংশ চিকিৎসকই নাকি ওষুধ কোম্পানির উপঢৌকন, সুবিধা বা নীরব কমিশনের বিনিময়ে প্রেসক্রিপশন লেখেন। প্রয়োজনের চেয়েও বেশি, কখনো অপ্রয়োজনীয় ওষুধ যুক্ত করে রোগীর ব্যয় বাড়ান। সুবিধা দেওয়া কোম্পানির ওষুধের নাম লেখেন। এ অভিযোগ হাওয়ায় তৈরি নয়। নানা গবেষণা, রিপোর্ট ও ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা বারবার একই ইঙ্গিত দেয়। স্বাস্থ্য খাতে অর্থনৈতিক প্রলোভন একটি গভীর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদাহরণস্বরূপ একটি সরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, চিকিৎসকদের বড় অংশ ওষুধ
কোম্পানির সঙ্গে আর্থিক সম্পর্কের কথা স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের নীতিমালায় এ ধরনের সুবিধা গ্রহণ নিষিদ্ধ হলেও কার্যকর নজরদারি নেই বললেই চলে। সততার চর্চাও নেই।
অন্যদিকে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার আগে সাক্ষীদের শপথ করানো হয়, ‘যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য ছাড়া মিথ্যা বলিব না।’ তাহলে প্রশ্ন জাগে, চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন কি রোগীর জীবনের ওপর সাক্ষ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ নয়?
একজন সাক্ষীর মিথ্যা কথা যেমন আদালতের রায়কে ভুল পথে নিতে পারে, তেমনি একজন চিকিৎসকের লাভনির্ভর প্রেসক্রিপশনের কারণে রোগীর আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
সেই বিবেচনায় একটি প্রস্তাব ক্রমশই জনগণের দাবি হয়ে উঠছে। সেটি হলো, চিকিৎসকদের কি রোগী দেখার আগে বা প্রেসক্রিপশন লেখার পর, একটি ‘স্বচ্ছতার শপথবাক্য’ পাঠের সিল মেরে স্বাক্ষর করার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা যায় না?
উদাহরণস্বরূপ প্রেসক্রিপশনে লেখা থাকবে- ‘আমি যেসব ওষুধ প্রেসক্রাইব করেছি, তার বিনিময়ে কোনো ওষুধ কোম্পানি বা কারও কাছ থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো সুবিধা গ্রহণ করিনি এবং করব না।’
প্রেসক্রিপশনের ওপরে বা নিচে যদি এমন একটি সিল থাকত, তাহলে রোগীর মনে আস্থা বাড়ত। চিকিৎসাব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত হতো।
কমিশননির্ভর চিকিৎসা অনেকটাই কমে আসত। ওষুধ কোম্পানির অযাচিত প্রভাব কমত। এবং চিকিৎসা আবার সেই মহান পেশার মর্যাদা ফিরে পেত। চিকিৎসকরা যদি সত্যিই কোনো কমিশন গ্রহণ না করেন, তাহলে এমন একটি শপথবাক্য সিল দিয়ে স্বাক্ষর করতে তাদের আপত্তি থাকার কথা নয়। বরং এটি তাদেরই মর্যাদা ও সততার স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আর যারা আপত্তি করবেন, সমাজ সহজেই বুঝে নেবে, আপত্তির কারণটা কী, কোথায় এবং কেন?
আজ যখন চিকিৎসা ক্রমশ কঠোর বাণিজ্যের রূপ নিচ্ছে, তখন স্বচ্ছতার এই শপথ হয়তো আর শুধু প্রস্তাব নয়, বরং সময়ের অনিবার্য দাবি। জনগণ যে এখন এ দাবি তুলছে, তা মোটেও অযৌক্তিক নয়। স্বাস্থ্য খাতকে বাঁচাতে হলে, চিকিৎসকের মর্যাদা রক্ষা করতে হলে, রোগীর আস্থা ফেরাতে হলে স্বচ্ছতার সিল এখনই প্রয়োজন।
♦ লেখক : আইনজীবী ও ওয়ার্ল্ড পীছ অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস সোসাইটির চেয়ারম্যান