বিশ্ব সভ্যতার দ্রুত পরিবর্তন, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়, বৈশ্বিক সংকট, ধর্মীয় বিভ্রান্তি এবং ইসলামভীতি- সব মিলিয়ে বর্তমান সময় মুসলিম উম্মাহর জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। সর্বত্র মুসলমান আজ দূরভিসন্ধিক্ষণ ও কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তবে প্রতিটি পরীক্ষা সুযোগও বটে। এই চ্যালেঞ্জপূর্ণ সময়ে ওলামায়ে কেরাম এবং সাধারণ মুসলমানদের কী করা উচিত, তা কোরআন ও হাদিসে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশিত। এ পরিসরে আংশিক আলোচনার প্রয়াস পাব, ইনশাআল্লাহ। ইসলামের মূল ভিত্তি হলো মানবজাতিকে ইহ ও পরকালের শান্তি ও কল্যাণের পথে আহ্বান করা। কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমার প্রভুর পথে আহ্বান কর প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে।’ (সুরা নাহল- ১২৫) আজকের বিশ্বে ইসলামের বিরুদ্ধে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে নানা উপায়ে। তাই ওলামায়ে কেরামের প্রথম দায়িত্ব হলো- যুক্তি, প্রজ্ঞা ও নরম ভাষায় ইসলামের সঠিক শিক্ষা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও, একটি আয়াত হলেও।’ (সহিহ বুখারি)
বর্তমান বাংলাদেশে ইমাম, মুয়াজ্জিন ও আলেম-ওলামা অগণিত। গোটা দেশের অধিকাংশ মানুষ আমাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাদের সঙ্গে আমাদের চলাফেরা। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, এই দেশে প্রতিনিয়ত বাতিল মতবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিভ্রান্ত হচ্ছে হাজারো মানুষ, কুসংস্কারে নিমজ্জিত হচ্ছে গোটা দেশ ও জাতি। আমরা এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কী চিন্তা করছি, সময় দিচ্ছি কী পরিমাণ? ভাবনার এখনই চূড়ান্ত সময়। মানুষকে সঠিক পথে উৎসাহিত করা, তাদের ভুল ধারণা অপনোদন করা আমাদের সবার ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ব।
মতভেদকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে যে বিভাজন তৈরি হয়েছে, তা উম্মাহর শক্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। অথচ কোরআনে আল্লাহর নির্দেশ, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রশ্মি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর, বিভক্ত হইও না।’ (সুরা আলে ইমরান-১০৩) মসজিদ-মাদ্রাসা, মাহফিল কিংবা সামাজিক জীবনে দলাদলি, নিন্দা-অপবাদ ছড়ানো এবং মতবিরোধকে শত্রুতায় রূপ দেওয়া ইসলামের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত। ওলামায়ে কেরামকে আন্তরিকভাবে নেতৃত্ব দিতে হবে ঐক্যের পথে। প্রয়োজনে মতভেদ করতে হবে ইসলামি শিষ্টাচার রক্ষা করে, মানবিক আদর্শের আলোকে।
উম্মাহর বড় সংকট হলো নৈতিকতার অবক্ষয়। সত্যবাদিতা, বিশ্বাসযোগ্যতা, মানবিক শিষ্টাচার, আমানতদারি- এসব ইসলামের মূল শিক্ষা। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি প্রেরিত হয়েছি উত্তম চরিত্রকে পরিপূর্ণ করতে। (মুসনাদ আহমদ) ওলামায়ে কেরাম ও মুসলমানদের উচিত সমাজের সর্বত্র সত্য ও স্বচ্ছতা, আদর্শিক পরিবেশ এবং ন্যায় ও মানবিকতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা। নৈতিক মানুষ ছাড়া দাওয়াহ কার্যকর হয় না। তাই আমলের মাধ্যমে উদাহরণ সৃষ্টি করাই হবে আমাদের প্রধান দায়িত্ব।
তরুণ সমাজ প্রযুক্তি, ভোগবাদ ও নৈতিক সংকটের ঘূর্ণিঝড়ে সঠিক পথ হারাচ্ছে। অথচ তারা উম্মাহর ভবিষ্যৎ। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সাত শ্রেণির মানুষ আল্লাহর আরশের ছায়ায় থাকবে, তন্মধ্যে ওই যুবক যে আল্লাহর ইবাদতে তারুণ্য অতিবাহিত করে। তরুণদের জন্য উপযোগী শিক্ষা প্রোপ্রাম, অনলাইনে সঠিক কনটেন্ট তৈরি, নেশা, পর্নোগ্রাফি ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা, তাদের দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও নেতৃত্ব বিকাশে সহায়তা করা সময়ের দাবি। ইসলাম জ্ঞানকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়েছে। কোরআনে কারিমে উল্লেখ হয়েছে, ‘যারা জানেন এবং যারা জানেন না-তারা কি সমান?’ (সুরা আয-যুমার-৯) ওলামায়ে কেরামের দায়িত্ব- ইসলামি ও আধুনিক শিক্ষা সমন্বিত করা, গবেষণানির্ভর দাওয়াহ, পরিবারনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশ- এসব বিষয়ে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা, সমসাময়িক বাস্তবতা বুঝে ইসলামি জ্ঞানকে যুগোপযোগী ভাষায় ব্যাখ্যা করা। ইসলাম শুধু নামাজ-রোজার ধর্ম নয়; এতে মানবিকতা ও সমাজসেবার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিশেষভাবে। কোরআনে কারিমে বর্ণিত হয়েছে, ‘তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মিসকিন, এতিম ও বন্দিকে খাদ্য প্রদান করে।’ (সুরা দাহর-৮) অতএব, আমাদের প্রয়োজন দরিদ্র ও বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, দুর্যোগে সহায়তা করা, সমাজে অসহায়দের অধিকার রক্ষা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সঙ্গে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সেরা মানুষ সে, যে মানুষের উপকার করে।’ (দারাকুতনি)। সঠিক তথ্য প্রচার করা, অপপ্রচারের যুক্তিসংগত জবাব দেওয়া, তরুণদের নৈতিক ডিজিটাল ব্যবহারে শিক্ষিত করা। মুসলিম উম্মাহর শক্তিশালী অস্ত্র হলো ইমান, জ্ঞান, চরিত্র, ঐক্য ও সেবা। যদি ওলামায়ে কেরাম বিশুদ্ধ দাওয়াহ, প্রজ্ঞা, ঐক্য ও নৈতিকতার মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন এবং মুসলমানরা নিজেদের জীবনে ইসলামের আদর্শ ফিরিয়ে আনেন তবে সমাজে শান্তি, ন্যায়বিচার ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত হবে, যা ইসলামের মূল উদ্দেশ্য।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা