আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মনে নানাবিধ নেতিবাচক প্রশ্ন এবং আশঙ্কা দানা বেঁধে উঠেছে! যখন যেখানে যার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছে তাদের প্রায় সবাইকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘এই সরকার নির্বাচন করতে পারবে তো?’ পার্কে হাঁটাহাঁটি করার সময়ও একদল লোক সেদিন আমাকে জেঁকে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই যে লেখক সাহেব, আদতে নির্বাচনটা হবে তো?’ আবার গতকাল সরকারি একজন পদস্থ কর্মকর্তা বললেন, ‘আসলে নির্বাচন হবে বা হচ্ছে কিনা?’ বলা বাহুল্য মানুষের মনে অকারণে এসব প্রশ্নের উদয় হয়নি! বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে এ সরকারের প্রতি জনমনে এক ধরনের অনাস্থার পরিবেশ তৈরি হওয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে মানুষ সন্দিহান হয়ে উঠেছে! কারণ গত পনেরো মাস ধরে সরকার যেসব বিষয় নিয়ে ঘষামাজা করেছে, তার অধিকাংশই জনগণের পক্ষে যায়নি, জনগণের কল্যাণে এই সরকার উল্লেখযোগ্য কিছুই করতে পারেনি! ফলে এই সরকারকে যারা ক্ষমতায় এনেছিলেন, তারা পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে চলে গেছেন! বিশেষ করে আগস্ট বিপ্লবে জেন-জির নেতৃত্বে থেকে যারা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ডেকে এনে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন, তারা পর্যন্ত এই সরকারের বিরোধিতায় সরব হয়েছেন!
এ অবস্থায় বর্তমান সরকার দেশটিকে একটি সংকটময় অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে বলেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে দেশের মানুষ সন্দিগ্ধ হয়ে পড়েছে! এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ছিল ছয় মাস বা এক বছরের মধ্যেই নির্বাচন দিয়ে সসম্মানে বিদায় নেওয়া। কিন্তু সে পথে না হেঁটে তারা এমন অনেক কিছু করতে গিয়েছে যার ফলাফল তাদের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে! কারণ একটি অনির্বাচিত সরকারের যেসব কাজে হাত দেওয়া উচিত ছিল না সেসব বিষয়েও তারা নাক গলিয়েছে, এমনকি সংবিধান সংশোধনের মতো বিষয়েও তারা উদ্যোগ নিয়েছিল যা তাদের দায়িত্ব, কর্তব্য, ক্ষমতা ইত্যাদি কোনো কিছুরই আওতাধীন নয়! আবার দায়িত্বকর্তব্যের মধ্যে পড়া অনেক কাজের বিষয়ে তারা হয় নির্বিকার থেকেছে অথবা ব্যর্থ হয়েছে! যেমন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী একজন শিক্ষক সেদিন বললেন, জমানো কিছু টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে তিনি এখন সর্বস্বান্ত, আবার অন্য একজন বেসরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাও আমাকে একই কথা বললেন। তাদের উভয়েরই কথা, ড. ইউনূসের মতো একজন বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ক্ষমতার শীর্ষে বসার পর আশান্বিত হয়ে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করায় গত এক বছরে তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ অর্ধেকে নেমে এসেছে এবং এখনো প্রতিনিয়ত পুঁজিবাজারে বড় ধরনের পতন ঘটে চলেছে! এ প্রসঙ্গে তাদের প্রশ্ন ছিল, তাহলে এসব দিকে কি ড. ইউনূসের কোনো নজর বা দায়িত্ব নেই? এ ক্ষেত্রে তো তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ!
সম্প্রতি জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সম্মেলনে সারা দেশ থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেল, একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ রণাঙ্গনের যোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও তিনি জাতীয়তাবাদী শক্তির পক্ষের লোক হওয়ায় পতিত সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী তাঁর গেজেট বাতিল করে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বন্ধ করে দেওয়ায় তিনি আদালতের মাধ্যমে রায় পেয়ে গেজেট পুনরুদ্ধার করতে পারলেও তাঁর বকেয়া ভাতা আটকে রাখা হয়েছে! বকেয়া ভাতা চেয়ে দরখাস্ত দাখিল করায় বলা হচ্ছে, আগের মন্ত্রী একটি অফিস আদেশ জারি করে এক আর্থিক বছরের ভাতা অন্য বছরে না দেওয়ার বিধান রেখে গিয়েছেন! কিন্তু এ বিষয়ে ভুক্তভোগীর দোষ কোথায় বা দায়দায়িত্ব কোথায়? সে প্রশ্নের জবাবেও বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার পক্ষ থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না!
উল্লেখ্য ভুক্তভোগী অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ ছাড়াও হিংসা, বিদ্বেষ এবং রাজনৈতিক কারণে অন্য আরও অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধারও গেজেট বাতিল করায় আদালতের মাধ্যমে তাঁরা গেজেট পুনরুদ্ধার করতে পারলেও তাঁদের বকেয়া ভাতাও একই আদেশে বন্ধ করে রাখা হয়েছে! এ বিষয়ে ভুক্তভোগী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বক্তব্য, দেশের কয়েক লাখ কোটি টাকা লুট হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে গেল, এমনকি গ্রামীণ ব্যাংকের কয়েক হাজার কোটি টাকার সুদ মওকুফ হয়ে গেল, অথচ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায্য প্রাপ্য এবং অধিকারের মাত্র কয়েক লাখ টাকা বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা এমনকি প্রধান উপদেষ্টার কাছে দরখাস্ত দাখিলের পরও তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না! পতিত স্বৈরাচারী সরকারের মন্ত্রীর একটি বেআইনি অফিস আদেশে প্রাপ্য আটকে রেখে তাঁদের অধিকার বঞ্চিত করা হচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয় বর্তমান সরকার একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবমূল্যায়ন করে চলেছে! তা ছাড়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ড. ইউনূসকে একটি কথাও বলতে শোনা যায়নি বলে মুক্তিযোদ্ধারা অভিযোগ করেন!
সেসব কথা না হয় থাক। আসন্ন নির্বাচন ঘিরে চারদিকে যেসব অনিশ্চয়তার কথা ঘনীভূত হয়েছে সেসব নিয়ে এখন কিছু বলা যাক। নির্বাচনসংক্রান্ত মাঠপর্যায়ে আমার প্রত্যক্ষ কিছু অভিজ্ঞতা আছে। কারণ আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমাকে দুই দফায় প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে ভোট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণসহ ভোট-পরবর্তী রেজাল্টশিট দাখিল পর্যন্ত কী কী ঘটন অঘটন ঘটে তার সবকিছুই আমার জানা। আর নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা কী তাও আমার নখদর্পণে। এ অবস্থায় আমাদের দেশের বর্তমান পুলিশ বাহিনী দিয়ে নির্বাচনের কাজটি কত দূর সুসম্পন্ন করা সম্ভব, সে বিষয়ে আমি নিজেও সন্দিহান, কারণ পুলিশ বাহিনী এখনো তন্দ্রাচ্ছন্ন! অনেকটা ঠেলেঠুলে তাদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে! দায়িত্বকর্তব্য পালনে একনিষ্ঠ এবং তৎপর একটি পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা এখনো সময়ের ব্যাপার। সামান্য একটি জিডি অ্যান্ট্রি করার পর দায়িত্বরত উপপরিদর্শকের পেছনে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে একজন সাংবাদিককে পর্যন্ত যেভাবে হেনস্তা হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেল, তাতে মনে হয় না এই পুলিশ বাহিনীকে দিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো একটি শক্ত কাজ করানো সম্ভব হবে! সুতরাং নির্বাচনে পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে যে প্রশ্ন বা সন্দেহটি দেখা যাচ্ছে সে বিষয়টিও ভেবে দেখার মতো। কারণ নির্বাচন ভন্ডুলের চেষ্টা করা গোষ্ঠীর তৎপরতার বিষয়টি এখানে গভীরভাবে বিবেচনা করলে নির্বাচনের আগে-পরে একটি শক্তিশালী এবং নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনীর ভূমিকার বিষয়টি অনস্বীকার্য। আর নির্বাচন ভন্ডুলের চেষ্টায় থাকা গোষ্ঠী কে বা কারা সে বিষয়টি বোধ হয় আমাদের সবারই জানা। প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা বাহিনীসহ এ দেশের শক্তিশালী একটি গোষ্ঠী যে নির্বাচনের আগে এমনকি নির্বাচনের দিন পর্যন্ত তাদের অপতৎপরতা চালিয়ে যাবে, সে বিষয়ে কারও সন্দেহ থাকা উচিত নয়। আর দেশীয় সেই গোষ্ঠীর তৎপরতায় প্রচুর অর্থশক্তি এবং জনশক্তিরও অভাব হবে বলে মনে হয় না।
উল্লেখ্য আমরা কথায় কথায় একাত্তরের পরাজিত শক্তি বলে যাদের চিহ্নিত করি, শক্তি সঞ্চয় করে তারাও যেহেতু ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সুতরাং চব্বিশের পরাজিত শক্তিও চুপচাপ বসে থাকবে না, সে কথাটি মাথায় রেখেই নির্বাচনের ময়দান প্রস্তুত করা সমীচীন বলে মনে করি। আর এ ক্ষেত্রে সরকার, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহ সবাইকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে, জুলাই আন্দোলনের ঐক্য ধরে রেখে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে তার উল্টো চিত্রই যেন আমরা দেখতে পাচ্ছি! কারণ বিএনপি, জামায়াত এমনকি এনসিপির মতো দলটিও যেভাবে রশি টানাটানির খেলায় মেতে উঠেছে, এক দল আরেক দলের প্রতি যেভাবে বিষোদগার করে চলেছে, তাতে তাদের মধ্যে ঐক্য বলতে কিছু আছে বলে মনে হয় না। এখানে আমরা শুধু একটা কথাই বলে রাখব, বেশি বাড়াবাড়ি করে নিজেদের ক্ষতি করা রাজনীতিকদের জন্য ভালো হবে না। কারণ তাদের অতীত আমাদের সবারই জানা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী দলটিকে যে সাবধানে পা ফেলতে হবে জনান্তিকে সে কথাটিও বলে রাখা হলো! কারণ তাদের বাড়াবাড়ির কারণে চব্বিশের বিপ্লবী দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হয়ে নির্বাচন ভন্ডুলকারী দেশিবিদেশি চক্র সফল হলে জামায়াতের অবস্থা কী হবে, সে বিষয়টিও তাদের ভেবে দেখতে বলি। আর সরকারের উদ্দেশেও বলতে চাই, নির্বাচন দিতে অনেক দেরি করে ফেলায় সরকারের ভাবমূর্তি যেভাবে নষ্ট হয়েছে, তাতে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পথ চলা তাদের পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়বে!
সুতরাং এখন নির্বাচনই একমাত্র ধ্যানজ্ঞান বিবেচনা করে সরকারকে বাকি সময়টুকু পথ চলতে হবে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ জ্ঞান, মেধা, শক্তি, সামর্থ্য সবকিছু নির্বাচনের পথে কাজে লাগিয়ে দেশ ও জাতিকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়াই এখন সরকারের একমাত্র কাজ বলে বিবেচিত হতে হবে। অন্যথায় দেশের মানুষের আশঙ্কাই কিন্তু সত্য বলে প্রমাণিত হতে পারে। বর্তমান সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে সফল না-ও হতে পারে! কারণ নির্বাচন হবে বা হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে জনমনে যে আশঙ্কা এবং নেতিবাচক প্রশ্নের উদয় হয়েছে সে কথারও যে যথার্থতা আছে উপরেল্লিখিত কথা বা বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা হলে তার যৌক্তিকতাও প্রমাণিত হবে। এ অবস্থায় দেশের মানুষের ধারণাটিকে গুরুত্ব দিয়ে, এখন থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত যে কোনো একটি অঘটন ঘটে যেতে পারে, সে বিষয়টি মাথায় রেখে বাকি দিনগুলো সাবধানে অতিক্রম করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। মনে রাখতে হবে, অঘটন ঘটানোর জন্য যারা তৎপর, তাদের গোপন তৎপরতা থেমে নেই, যে কোনো সময় তারা তাদের ফর্মুলা বাস্তবায়নের জন্য সক্রিয় হয়ে মাঠে নামতে পারে, সুতরাং সাধু সাবধান!
লেখক : কলামিস্ট, বীর মুক্তিযোদ্ধা