ইউরোপ পারে। আমেরিকা পারে। প্রাকৃতিক গজব থেকে রক্ষা পাওয়ার, সেই গজব সামাল দেওয়ার ব্যবস্থা আমরা কেন করতে পারি না?
দেশের কোনো জায়গায় বিরাট দুর্যোগ ঘটে যাওয়ার পর এ ধরনের প্রশ্ন তোলাটা আমাদের স্বভাব হয়ে গেছে। গেল ২১ নভেম্বর দেশময় ভূমিকম্পের পর শোনা গেছে, জানমাল সুরক্ষায় আমরা এত ব্যর্থ কেন? বহু বছর আগে ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পরও কর্তৃপক্ষকে অবিরাম দুষেছে বাঙালি।
১৯৭০-এর ১২ নভেম্বর গভীর রাত থেকে ১৩ নভেম্বর ভোর ৬টা পর্যন্ত উপকূলীয় জেলাগুলোয় ২২২ কিলোমিটার গতিতে ঝড় বয়ে যয়। এ সময় সাগরের পানি ৩৪ ফুট উঁচু হয়ে উপকূলে আঘাত হানে। এতে ৬ লাখ মানুষের প্রাণ যায়। বাড়িঘর ধসে পড়ে ৪ লাখেরও বেশি। চুরমার হয় মাছধরার ২০ হাজার নৌকা। নিশ্চিহ্ন হয় সাড়ে ৩ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
উপকূল থেকে ত্রিশ মাইল উত্তরে জেলা শহরে আমার বাড়ি। প্রাকৃতিক তাণ্ডবের সময় ছিলাম ঢাকায়। মহাদুর্যোগের সংবাদ পাওয়া মাত্রই উদ্বেগ শুরু- ‘বাড়ির সবাই বেঁচে আছে?’ ট্রেনে চেপে ১৩ নভেম্বর দুপুরে রওনা দিই। রাত ৮টায় বাড়ি পৌঁছলাম। ধসে না পড়লেও বাড়ির ঘর দুটি ক্ষতিগ্রস্ত। বাবা-মা ভাইবোনরা বেঁচে আছেন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই বাল্যবন্ধু রেজাউল করিম বাহাদুরের আগমন। সে জানায়, কাল সকালে রিলিফ টিম যাবে উপদ্রুত এলাকায়। তার হুকুম- টিমে তুইও থাকবি।
বাহাদুর নামকরা ফুটবলার। দিনভর শহরের বিভিন্ন প্রান্তের বাড়ি বাড়ি ধরনা দিয়ে ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করেছে। এগুলো দুর্গতদের মধ্যে বিতরণের জন্য খালপথে নৌকায় করে নিয়ে যাওয়া হবে। তিন দিন থাকতে হবে দুস্থজনের পাশে। রান্না খাওয়াদাওয়া নিদ্রা সবই নৌকায়। গোসল? তা যদি করতেই হয় হাত বাড়ালেই খালের পানি।
বেলা ১টার কিছুক্ষণ আগে একটা গ্রামে পৌঁছলাম আমরা। খালপাড়ে অপেক্ষমাণ শ দুয়েক লোক। তাদের মধ্যে থাকা ২০-৩০ যুবক হর্ষধ্বনি দেয়- ‘গোলি বাহাদুর ভাই জিন্দাবাদ।’ বয়স্করাও ইলেভেন স্টার টিমে গোলকিপার বাহাদুরকে চিনেন। এক প্রবীণ কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন, বায়াদুর বাই আমনে আঙ্গোরে অ্যাতো বালোবাসেন। দোয়া করি আল্লাহ আমনেরে হাজার বছর হায়াত দিক।’
শুকনো খাবার, কিছু চাল-ডাল, কেরোসিন তেল, মোমবাতি, গামছা, লুঙ্গি, রেডিমেড শার্ট দেওয়া হলো। যারা নিল তারা খোলা আকাশের নিচে সংসার পাতানো মানুষ। একজন অনুরোধ করল, ‘আইয়েন আংগোল্লগে চাইট্টা ডালভাত খান। কত কষ্ট কইরছেন, এককানা জিরাই লন।’ আমরা তাদের সঙ্গে খিচুড়ি খেয়েছি। আমাদের আগে আসা রিলিফ টিম প্রদত্ত চা-পাতা চিনি আর কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে বানানো চা অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে ভরে খাইয়েছে তারা। চা খেয়ে আমরা নৌকায় উঠতে যাব, হঠাৎ আওয়াজ এলো কানে- ‘বঞ্চনা অনেক সহ্য করেছি। আর না। দ্যাশ
স্বাধীন হলো তেইশ বছর হয়ে গেছে। এত বছরেও ঝড়-তুফান আর গোর্কির আজাব থেকে আমাদের রক্ষার বন্দোবস্ত করা হয় নাই। খালি ওয়াদা আর ওয়াদা। বান্দরের পদাইশ বান্দরগুলা ওয়াদা করে তোমাদের জানমালের নিরাপত্তায় হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা...।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেল স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে আশ্রয় নেওয়া লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করছেন নেজামুল হক মেম্বর। চোঙায় মুখ লাগিয়ে ভাষণ। বক্তার গলা গমগমে। তাই, মনে হচ্ছিল মাইকে বলছেন। নৌকা এগিয়ে চললেও মেম্বরের আওয়াজ আসছিল, ইউরোপ-আমেরিকা তিন বছরে তুফান-গোর্কিরে তাগো হুকুমের দাস বানায়। তোমরা তেইশ বছরেও পার না। পারবা ক্যামনে? তোমরা চোট্টার বংশ। তোমাদের হাড্ডিতে চুরি, রক্তে চুরি, মাংসে চুরি, তোমাদের দমে দমে চুরি। বাঙালি আজ ঐক্যবদ্ধ। তারা চোরের বংশরে নির্বংশ করবেই করবে...।
২.
বাংলাদেশ পুলিশের প্রথম মহাপরিদর্শক (ইন্সপেক্টর জেনারেল-আইজি) আবদুল খালেক। পরে তিনি স্বরাষ্ট্র সচিব পদে উন্নীত হন। তখনো অনেকে তাঁকে ‘আইজি খালেক’ বলে উল্লেখ করতেন। এমনকি তিনি নিজেও। তাঁর লেখালেখির অভ্যাস ছিল। প্রবন্ধ লিখতেন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ জনজীবনের জন্য যে ভয়ানক বিপদ তৈরি করছে তার নিখুঁত ছবি ফুটে উঠত তাঁর নিবন্ধে। তাঁর লেখা ‘ঘষামাজা’ করবার জন্য মাঝেমধ্যে আমায় অনুরোধ করতেন।
১৯৯১ সালের এক বিকালে আবদুল খালেক (জন্ম ১ মার্চ ১৯২৭-মৃত্যু ১০ জুন ২০১৩) আমায় ফোন করেন। অফিসে খুব ব্যস্ততার মধ্যে থাকায় তাঁর কণ্ঠস্বর অন্যরকম মনে হচ্ছিল। তা ছাড়া রাজধানী নগরীতে ‘খালেক’ নামে তিনজনের সঙ্গে আমার জানাশোনা। তিনি তাঁর নাম বললে প্রশ্ন করি, কোন্্ খালেক? তাঁর জবাব, ‘তোমার খালেক ভাই বলছি।’ জানতে চাইলাম কোন্্ খালেক ভাই? তিনি বলেন, ‘মহামুশকিল! এতক্ষণেও চিনলে না! আরে আইজি খালেক বলছিরে ভাই।’
আমার তদানীন্তন কর্মস্থলের প্রধান কর্তার সঙ্গে আড্ডা দিতেন আবদুল খালেক। সেখানে মাঝেমধ্যে উপস্থিত থাকতাম আমি। সহকর্মী শামসুল আনোয়ার মানিকও থাকতেন। মাসে চার দিন উপসম্পাদকীয় লিখতেন মানিক। লেখাগুলো পড়ে মন্তব্য করতেন আবদুল খালেক। এক লেখায় ছিল অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবের পেছনে সরকারি তহবিল অপচয়ের তীব্র সমালোচনা। আইজি খালেক বলেন, আক্রমণটা ভালোই। ভাষাটা ছিল অশোভন। উচ্চ চিন্তার জানান দেওয়ার সময় নিচজনের বুলি প্রয়োগ বিষয়ের মাধুর্য উবে যায়। করদাতার টাকায় গড়া তহবিল যারা বরবাদ করে তারা অবশ্যই নরাধম। সেজন্য নরাধমকে বাপ তুলে গালি দেবে? যে গালি দিল সে-ই তো শ্রোতার দৃষ্টিতে ছোট হয়ে গেল।
‘স্যরি, খালেক ভাই। সাবধান হয়ে গেলাম। আর ওরকম হবে না’ বলেছেন শামসুল আনোয়ার মানিক, ‘সেন্টিমেন্টাল হয়ে অমন প্রশ্ন করেছিলাম।’ মানিকের লেখায় প্রশ্ন ছিল, টাকাটা ওই হারামিদের বাবার? দুই দিকে রাস্তা নেই। ফসলি খেতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ৩০ ফুট দৈর্ঘ্য আর ১২ ফুট প্রস্থের পাকা সেতু। বর্ষাকালে নৌকায় চেপে সেতুর কাছে পৌঁছা যাবে হয়তো, কিন্তু অত উঁচু সেতুতে ওঠা সম্ভব হবে না। এরকম সেতুকে কোনো উন্মাদও তো উন্নয়নের স্মারক বলবে না।
এক দুপুরে আইজি খালেকের সঙ্গে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ে মতবিনিময় করছিলাম। তিনি বলেন, বিরাট কোনো ঘটনায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলে আমরা বাঙালিরা খুব উত্তেজনায় কাঁপি। সেটা খারাপ না। কেঁপে ওঠার অধিকার মৌলিক অধিকার। সমস্যা হলো কাঁপতে কাঁপতে আমরা বিশেষজ্ঞ হয়ে যাই। সশব্দ পরামর্শ দিতে দিতে মুখে ফেনা তুলি : ‘এমন করলে অমন হতো না। তেমন না করলে তো এমন হতে পারত। কইলাম সামনে যেতে, গেছে পিছনে।’ তারপর আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়ি। লাগলে আগুন মাররে মার পানি/ নিভলে আগুন বালিশ টানি, অবস্থা আরকি।
খোলাসা করে তিনি বলেন : কিছু লোকের স্বভাব বিপদ দেখলে সেটা দূর করবার জন্য দেওয়ানা হয়ে যাওয়া। বিপদ যেই কেটে গেল কিংবা স্তিমিত হলো অমনি তারা মৃতদের মতো বোবা হয়ে যায়। এরা আগুন লাগলে নেভানোর জন্য এরে ডাকে ওরে ডাকে। আগুন নিভে গেলে নাক ডেকে ঘুমানোর মতলবে বালিশ সন্ধানে নেমে পড়ে।
৩.
একুশ ও বাইশে নভেম্বর (২০২৫) চারবার ভূমিকম্পে ঝাঁকুনি খায় বাংলাদেশ। প্রথম দিনের ভূমিকম্পে ১০ জন নিহত ও ৬ শতাধিক আহত হয়েছে। এরপর আসন্ন বিপদ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা যেসব কথা বলছেন তাতে আতঙ্কিত হচ্ছেন অনেকে। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার জানান, ভূ-অভ্যন্তরে যে ফাটল বা ফল্ট লাইনটি এত দিন ধরে প্রচণ্ড চাপে একে অপরের সঙ্গে আটকে ছিল, তারা এখন নড়তে শুরু করেছে।
দ্বিতীয় দিনের ভূমিকম্পের পর তথ্য পাওয়া গেল, গত পাঁচ বছরে ৩৯টি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশ ভূখণ্ডে। এর ২৮ শতাংশের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার ৬ থেকে ৮৬ কিলোমিটারের ভিতর। ২১ নভেম্বর হয়েছিল ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প; এর উৎস ছিল নরসিংদীর মাধবদী। উৎপত্তিস্থলের গভীরতা ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে। এই গভীরতা যত কম হবে তত ঝাঁকুনি বেশি হবে।
আমাদের ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনার যে অবস্থা তাতে মনে হয়, আপৎকালে চটজলদি আশ্রয় গ্রহণ কিংবা আহত হলে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর মুগ্ধকর পদ্ধতি অর্জনে গভীর মনোযোগ দিতে দিতে আমরা আরও পাঁচ/ছয় বছর খরচ করে দিতে পারি। আমরা এখন ‘লাগলে আগুন মাররে মার পানি’ পরিবেশে দিনাতিপাত করছি। প্রচণ্ড ঝাঁকুনির আশঙ্কা থেকে মুক্ত হতে কত দিন লাগবে জানি না। বিখ্যাত গল্পকার কুদরত উল্লাহ শাহাব রচিত গল্পে আছে ‘নায়ক যে বেতন পায় তাতে বারো দিন ভালোই চলে। বাকি আঠারো দিনের দশ দিন ধারকর্জ করে চলা যায়। অবশিষ্ট আট দিন আল্লাহ আল্লাহ।’
স্টাইলটা অনুসরণযোগ্য। সাহসের সঙ্গে ভূমিকম্পের মোকাবিলা করবার মতো কোনো ব্যবস্থা যত দিন পর্যন্ত না বাংলাদেশ চালু করার সক্ষমতা পাচ্ছে, তত দিন আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা জানাতে পারি, হে রাব্বুল আলামিন! ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের গভীরতা তুমি খুব বাড়িয়ে দাও। কোনো যন্ত্র বা প্রযুক্তি দিয়ে যেন সেই গভীরতা মাপা না যায়।
২১ নভেম্বর ছিল শুক্রবার। মসজিদে মুসল্লিদের প্রচণ্ড ভিড়। জুমার নামাজ পড়েছি রাস্তায়। সেখানে নামাজ শেষে অস্থায়ী দোকান থেকে নিত্যপণ্য কেনার জন্য উতলা ব্যক্তিদের আচরণ পর্যবেক্ষণ আমার অভ্যাস। শসা কিনতে গিয়ে দুই ক্রেতার সংলাপ শুনি। সবুজ পাঞ্জাবি পরা ক্রেতা বলেন, ‘দুই কেজি শসায় কী হবে। পাঁচ কেজি নেন। ঘুমের মধ্যে ভূমিকম্পে বিল্ডিং ধইসা পড়লে তো ইট-সিমেন্টের টুকরার মধ্যে আইটকা চিতই থাকবেন। ধরেন গিয়া তিন দিন আইটকা থাকতে হইল। তখন শসা খাইয়া জীবন বাঁচাইতে পারবেন।’
‘কী যে কন! এতই যদি বুঝেন, আপনি তো এক কেজিও কিনলেন না।’ বলেন সাদা পাঞ্জাবি পরা ক্রেতা, ‘আপনি কিনলেন হাফ কেজি মাত্র।’ সবুজ পাঞ্জাবি বলেন, ‘আমার অত টাইম কোথায়? আমি যে বাড়িতে ভাড়ায় বাস করি, সেটা এমনভাবে বানাইছে ৬ মাত্রার কম্পন হইলেই কর্ম সারা। বিল্ডিং ধপাস। বিল্ডিংয়ের বাসিন্দারাও ধপাস। বেশি শসা নিলে খাইব কেডা? দশ দিন পর উদ্ধারকর্মীরা যদি আসেও মরা বাইর করতে করতে তাদের জানও বারাইয়া যাবে।
৪.
কৈশোরে আরবি ভাষা শিখতাম আলিয়া মাদ্রাসার সিনিয়র ছাত্র আতিকুর রহমানের কাছে। তিনি বলতেন, যে ঘরে ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্তিকুন্তু মিনাজজোয়ালিন’ লিখে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা থাকে ভূমিকম্পে সে ঘরের সবাই নিরাপদ থাকে। তাঁর কামরায়ও ওরকম লেখা ঝোলানো দেখেছি। কিন্তু এক সকালে আমাদের পাঠকক্ষ কেঁপে উঠলে তিনি দ্রুত টেবিলের নিচে চলে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘জলদি খাটের নিচে ঢুকে বসে থাক। সহপাঠী রহমত বলে, ‘আপনি কইছিলেন...।’
আতিক হুজুর বলেন : কওয়া কওয়ি বাদ দে। যে হুকুম করলাম তুই সেটা তামিল কর। মনে রাখবি, বাঁচন আগে, তর্কাতর্কি পরে।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন