সৃষ্টির শুভলগ্নে মানুষ যাযাবর ছিল এবং সময়ের বিবর্তনে ধীরে ধীরে মানুষ সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছে। তবে আধুনিক এই পৃথিবীতে এখনো কিছু যাযাবর জাতি-উপজাতি টিকে আছে। লিখেছেন- সেলিনা শেলী
গাবরা জাতি
আফ্রিকার পূর্বাঞ্চল বিশেষত কেনিয়ার লোয়ার ও লওডানে এবং ইথিওপিয়ার মোর-এর কাছাকাছি মরুভূমি অঞ্চলে গাবরা জাতির বসবাস। কঠিন পরিবেশের সঙ্গে মানানসই জীবনধারা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী এই যাযাবর গোষ্ঠী। তারা মূলত পশুপালন ও কৃষিকাজ করে জীবনযাপন করে এবং এগুলো এ জাতির প্রধান পেশা। তবে শিকার তাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা পশু পালনের জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়ায়। গবাদি পশুর মধ্যে রয়েছে- উট, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদি। গাবরা জাতি বাঁশ, চট, পশুর চামড়া ইত্যাদি দিয়ে গোলাকৃতির ঘর তৈরি করে তাতে বসবাস করে। তাদের সমাজ ও জীবনযাত্রায় ধর্মের প্রভাব অত্যন্ত দৃঢ়। ইসলামের প্রতি গভীর আস্থা তাদের। তারা মরুভূমি অঞ্চলের কঠিন ও শিকারি জীবনকে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পালন করে। সাধারণত পুরুষরা গাবরা সমাজের রক্ষক এবং সমাজের নেতৃত্বসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যেমন- পশু পালন ও খাবার সংগ্রহের কাজগুলো করে থাকে। গাবরা মহিলারা মুখে গয়না পরে এবং লাল ও সোনালি রঙের পোশাক বেশি পরে যা তাদের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খায়। ধর্মীয় আচার উৎসব তাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। অতিথিদের তারা পরিবারের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে। তাদের পারস্পরিক সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মঙ্গোলিয়ান যাযাবর জাতি
দুনিয়া কাঁপানো যোদ্ধা চেঙ্গিস খানের দেশ মঙ্গোলিয়া। ১ লাখ ৬৪ হাজার ১০০ বর্গ কিমি আয়তনের স্থলবেষ্টিত এশিয়ার অন্যতম দেশ। যার উত্তরে রাশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব চীন দ্বারা পরিবেষ্টিত। দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ মানুষই যাযাবর। বিস্তীর্ণ পার্বত্য ভূমিতে আদিম মানুষের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এসব মানুষ। চারণভূমি খুঁজে বের করে তাদের অস্থায়ী ‘গের’ নামক গোলাকার তাঁবু স্থাপন করে; যা সহজে খোলা ও বন্ধ করা যায়। ধরা যায় বরফের সঙ্গেই তাদের বসবাস। মঙ্গোলিয়ান এ জাতির জীবিকা ও অর্থনীতি গবাদি পশুর ওপর নির্ভরশীল। গবাদি পশুর মধ্যে ঘোড়া, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি। যাতায়াতের ক্ষেত্রে ঘোড়া তাদের গুরুত্বপূর্ণ বাহন এবং ঘোড়ার পিঠে করেই তারা পশু চরায়। শীতের সময় সোনালি চিল দিয়ে শিকার করে খাদ্যে জোগায়। কিন্তু অবাক করা বিষয়টি হলো- পাঁচ মাস পর এই শিকারি চিলটিকে আবার নীল আকাশে মুক্ত করে দেয়। তারা প্রচুর ভেড়া, বকরি ও দুগ্ধজাত খাবার খায়। এমনকি প্রচণ্ড শীতের দিনগুলোয় টিকে থাকতে তারা মাখন মিশিয়ে চিনির বদলে লবণ দিয়ে দুধ চা খায়। শীত-গ্রীষ্মে আতিথেয়তায় মাংস ও দুগ্ধজাত খাবার পরিবেশন করে। পশম, তুলা, সিল্ক দিয়ে তৈরি ‘ডিল’ নামক ঐতিহ্যবাহী গাউন জাতীয় লম্বা পোশাক পরে যার ডান দিকে ঘাড় পর্যন্ত বোতামযুক্ত। পুরুষরা এই বিশেষ পোশাকের সঙ্গে কোমরে বিপরীত রঙের একটি বেল্ট পরে, মাংস কাটার জন্য তার মধ্যে ছুড়ি গুঁজে রাখতে। ঠান্ডা থেকে বাঁচতে এই পোশাকের সঙ্গে বুট ও টুপি পরে তারা। বিয়ের ক্ষেত্রে তাদের নারীদের কুমারী হতে হয় না। এ জাতির মধ্যে চীন ও তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মের প্রভাব দেখা যায়। ঘোড়ায় চড়ে খেলাধুলা তাদের অন্যতম উৎসব। তিন-চার বছরের ছোট বাচ্চারাও ঘোড়ার পিঠে চড়া শেখে। হয়তো এ কারণেই চেঙ্গিস খান ঘোড়ায় চড়ে তার বাহিনী নিয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে গিয়ে রাজ্য জয় করতে পেরেছেন।

থারু জাতি
ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও উৎসব তাদের সমাজের অঙ্গ। তারা সহানুভূতির মাধ্যমে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এবং জীবনযাত্রায় আধুনিকতার প্রভাব থেকে দূরে থাকে
এশিয়া মহাদেশের নেপাল ও ভারতের তারাই অঞ্চলে বাস করে থারু জাতি। তাদের জীবনযাত্রা বনের কাছাকাছি হওয়ার ফলে কৃষি ও পশুপালন জীবিকা নির্বাহের প্রধান মাধ্যম। তারা জমি চাষ ও মাছ শিকার করে খাদ্য সংগ্রহ করে। ধান, গম ও ভুট্টা তাদের প্রধান ফসল। থারুদের মধ্যে দীর্ঘ সময় ঘরে বসবাস করার একটি যৌথ পরিবার প্রথা প্রচলিত। তাদের অত্যন্ত শক্তিশালী পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। তারা একে অপরের সহায়তায় কাজ করে। সম্মানজনক সামাজিক কাঠামো অনুসরণ করে একজন পুরুষের নেতৃত্বে পরিবার ও সম্প্রদায় চলে। থারু সম্প্রদায়কে রানা, কাঠারিয়া, ডাংগাঊরা, কচিলা ও মেখ নামক পাঁচটি উপগোষ্ঠীতে ভাগ করা হয়। তারা ইন্দো-আর্য ভাষাভাষী গোষ্ঠী। থারু মেয়েদের ভারী গয়না ও লাল সাদা রঙের পোশাক পরা বেশি পছন্দ। থারু জাতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো তাদের সংস্কৃতি, যা অত্যন্ত পুরোনো এবং ঐতিহ্যপূর্ণ। তারা বিভিন্ন ধরনের সংগীত, নৃত্য ও গানকে জীবনের অংশ হিসেবে পালন করে। বিশেষ করে ‘থারু নৃত্য’ তাদের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতি। থারুরা বনের আত্মাদের পূজা করে। তবে হিন্দু মানুষ বেশি হলেও মুসলিম ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষও আছে। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও উৎসব তাদের সমাজের অঙ্গ। তারা সহানুভূতির মাধ্যমে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এবং জীবনযাত্রায় আধুনিকতার প্রভাব থেকে দূরে থাকে।

পিগমি জাতি
আজকের বিশ্বে যাযাবর পিগমিদের সংখ্যা সর্বসাকল্যে ১ লাখের বেশি হবে না। তবে সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় এ জাতি আজ বিলুপ্তির পথে
পিগমি একটি প্রাচীন বা আদিমতম মানব গোষ্ঠী। খ্রিস্টপূর্ব ২২৫০ অব্দের একটি চিঠিতে এই জাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। পিগমিরা আফ্রিকার রেইন ফরেস্টের দুর্গম জঙ্গলে বসবাস করে। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে এখনো এদের অস্তিত্ব আছে এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতেও অস্তিত্ব ছিল। এ জাতির মানুষের উচ্চতা ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি বা তার কম। তাই তারা বিশ্বে সবচেয়ে খর্বাকৃতির বা বামন মানুষ হিসেবে পরিচিত। পিগমিরা জঙ্গলে গাছের ডাল বাঁকিয়ে ছোট ছেট কুঁড়েঘর তৈরি করে তাতে বসবাস করে। তাদের ঘরগুলো আকার ও উচ্চতায় ছোট হয়। জঙ্গলবাসী এই আদিম মানবজাতির জীবনযাত্রা বনভূমির মধ্যেই সংগঠিত হয়। তারা শিকার, মাছ ধরা, ফলমূল, মধু সংগ্রহ ও বনায়নের মাধ্যমে তাদের খাদ্য সংগ্রহ করে। শিকারের জন্য তারা ‘এনকুসা’ নামের এক ধরনের গুল্ম দিয়ে খুব পাকাপোক্ত জাল তৈরি করে দলবেঁধে শিকার করতে জঙ্গলে যায়। শিকার তাড়া করে কোমরসমান উঁচু সেই জালের মধ্যে শিকারকে আটকে ফেলে। শিকার বড় হলে জালবদ্ধ অবস্থায় তীর ছুড়ে দুর্বল করে তারপর বেঁধে আবার দলবেঁধে গ্রামে ফিরে আসে। তাদের দলনেতাকে তুখোড় শিকারি হতে হয় আর কঠিন পরীক্ষা দিয়ে তবেই দলনেতা নির্বাচিত হয়। পিগমিদের মধ্যে একটা প্রথা আছে, পুরুষরা বড় শিকার ধরে গ্রামে ফিরলে নারীরা দলবেঁধে নাচ করে। তাদের বিশ্বাস, এই সময় যদি কোনো নারী গর্ভাবস্থায় থাকে তাহলে শিকার-পরবর্তী উৎসব তার সৌভাগ্যের প্রতীক। তারা গাছের ছাল, পাতা এবং পশুর চামড়া দিয়ে নিজেদের পোশাক তৈরি করে। প্রকৃতির সঙ্গে তাদের গভীর ও শক্তিশালী সম্পর্ক থাকার মাধ্যমে জীবনের ভারসাম্য বজায় থাকে। তাদের জনগণ আত্মনির্ভরশীল ও কমিউনিটি ভিত্তিক জীবনে বিশ্বাসী এবং ধর্মীয় বিশ্বাস আধ্যাত্মিক প্রকৃতির দেবতাকে বিশ্বাস করে। একে অপরকে সহযোগিতা করে কাজ করে ও অতিথিদের সর্বদা সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করে যা তাদের সামাজিক মূল্যবোধের অংশ। তাদের সংস্কৃতি পৃথিবীজুড়ে প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা একটি চমৎকার উদাহরণ। পিগমিরা কয়েকটি উপজাতি যেমন- মুবুতি, বাকা ইত্যাদি। বর্তমানে পৃথিবীতে পিগমির সংখ্যা ১ লাখের বেশি হবে না। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় এই জাতিগোষ্ঠী বিলুপ্তির পথে।

কোচিস উপজাতি
কোচিসদের পোশাক ঢিলেঢালা, সুচিকর্ম এবং আয়নার অলংকরণের জন্য পরিচিত। কখনো কখনো খরা, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাদের যাযাবর জীবন কঠিন ও বাস্তুচ্যুত হয়
কোচিস উপজাতির বাস মধ্যপ্রাচ্যের আফগানিস্তানে। তাদের ‘কুচিস’ও বলা হয়। মূলত কোচিসরা আধা যাযাবর পশতুন সামাজিক গোষ্ঠী। জাতিগতভাবে পশতুন হলেও তাদের একটি স্বতন্ত্র সামাজিক গোষ্ঠী হিসেবে দেখা যায়। কোচিসরা পিতৃতান্ত্রিক ধারায় উপজাতিতে সংগঠিত হয় এবং তাদের নেতার নাম হয় খান। এই উপজাতি আফগানিস্তানের শেষ যাযাবর জাতি। এরা একসময় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী প্রধান ব্যবসায়ী ছিল। তারা মাংস, দুগ্ধজাত পণ্য, পশম, শস্য, শাকসবজি উৎপাদন করে এবং স্থায়ী বসতিতে বসবাস করা কোচিসরা অন্যান্য পণ্যেরও ব্যবসাও করত। ঋতু ভেদে পশু পালনের জন্য চারণভূমির সন্ধানে তারা দেশজুড়ে ঘুরে বেড়ায়। ১৯৬০-এর দশকে সীমান্ত বন্ধ হয়ে গেলে আফগানিস্তান ও সিন্ধু উপত্যকার মধ্যে বণিক ঘিলজি কোচিসদের দীর্ঘ দূরত্বের অভিবাসন বন্ধ হয়ে যায়। পশু পালন এই উপজাতির জীবিকার প্রধান উৎস। তারা উট, ভেড়া, ছাগল, ইত্যাদি লালনপালন করে। তারা আফগানিস্তানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই উপজাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তাদের যাযাবর জীবনযাপনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাঁবুতে বাস করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু স্থায়ী সম্প্রদায়ের কোচিসরা মাটি দিয়ে দেয়াল তৈরি করে গ্রামীণ বাড়িঘর নির্মাণ করে তাতে বসবাস করে এবং কৃষিকাজে যুক্ত হয়। নানানরকম সমস্যার কারণে বর্তমানে কেউ কেউ শহরে বসবাস করতে শুরু করেছে। কোচিসদের খাদ্য তালিকায় আছে রুটি, মাংস, শুকনো ফল, বাদাম ও দুগ্ধজাত খাবার। কোচিসদের খাদ্যাভ্যাস এমনভাবে তৈরি যা তাদের শারীরিক শক্তি এবং কর্মক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। কোচিসদের পোশাক ঢিলেঢালা, সুচিকর্ম এবং আয়নার অলংকরণের জন্য পরিচিত। কখনো কখনো খরা, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাদের যাযাবর জীবন কঠিন ও বাস্তুচ্যুত হয়।

ওরা বা বাজাউ উপজাতি
আমরা ভূপৃষ্ঠের যাযাবর মানুষ ও জাতির কথা জানলেও সমুদ্রে যাযাবর জীবনযাপন করা ‘ওরা’ বা ‘বাজাউ’ মানুষের কথা কমই জানি। ‘ওরা’ গোষ্ঠীকে সমুদ্রের যাযাবর বাজাউ বলা হয়। বাজাউদের পুরো জীবন কাটে সমুদ্রে। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত ব্রুনাই, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের কয়েকটি উপসাগর- সুলু, জাভা, সেলেবিস, বান্দা, ফ্লোরেন্স ও সাভু। এ উপসাগরগুলোর নীল পানিতে বিশেষ আকৃতির নৌকা লুপাতে চড়ে ঠিকানাবিহীন ঘুরে বেড়ায় বাজাউরা। এ জন্য তাদের ‘সি জিপসি’ বলা হয়ে থাকে। তীর থেকে আধা কিলোমিটার দূরে অগভীর পানিতে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি করেন পাকাপোক্ত অস্থায়ী ঘর ও গ্রাম। যা চাইলে আবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খুলে ফেলা যায়। ঘরের নিচ দিয়ে বয়ে যায় সমুদ্রের ঢেউ। ছোট ছোট ডিঙির মতো নৌকায় করে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যেতে হয়। এ জাতি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নৌকা বা এই অস্থায়ী ঘরেই থাকে। কেউ কেউ তো স্থলের মাটিই দেখে না কোনো দিন। তারা নিজেদের বয়স বলতে পারে না, কারণ ঘড়ি না থাকায় সময় সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। বিদ্যুৎ নেই বলে রাতের বেলা মাছের তেল দিয়ে মশাল জ্বালায়। অত্যন্ত শান্ত ও আমুদে বাজাউ উপজাতি সামুদ্রিক খাবারের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। সমুদ্রের তীরবর্তী কিছু মানুষ মাছের বিনিময়ে তাদের জ্বালানি কাঠ, খাবার পানি ও পোশাক দিয়ে থাকে। বাজাউ শিশুরা হাঁটার আগেই সাঁতার শিখে যায় এবং সমুদ্রে মাছের মতো সাঁতার কেটে খেলা করে। নারী-পুরুষ সবাই মাছ ধরতে খুব পারদর্শী এবং জলের নিচে তারা পানির ওপরের মতোই সাবলীল। বেলা বাড়লে কাঠ ও ফেলে দেওয়া কাচ দিয়ে নিজেদের তৈরি এক ধরনের চশমা পরে এবং কোমরে পাথর বেঁধে ২৩০ ফুট পানির নিচে মাছ ধরতে নেমে পড়ে বাজাউ পুরুষেরা। তাদের বানানো কাঠের অদ্ভুত বন্দুক দিয়ে তীর ছুড়ে মাছ ধরে। অবাক করা বিষয় হলো- বাজাউরা পানির এত নিচে যেতে পারার কারণ তারা ১০ থেকে ১৩ মিনিট শ্বাস ধরে রাখতে পারে। এ বিষয়ে গবেষক মেলিসা ইলার্ডো বলেন-‘মানুষের প্লিহা হলো অক্সিজেনযুক্ত লোহিত রক্তকণিকার ভাড়ার ঘর। ডুবন্ত বাজাউদের প্লিহা ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে রক্তের স্রোত অক্সিজেনেযুক্ত লোহিত কণিকার জোগান দেয়। মূলত সামুদ্রিক পরিবেশে টিকে থাকার জন্য শত শত বছর ধরে মাছ সংগ্রহের জন্য সমুদ্রের গভীরে যাওয়ার অভ্যাসেই তাদের এমন পরিবর্তন। ইতিহাসে আছে- হাজার বছর আগে দক্ষিণ এশিয়ার জোহর রাজ্যের রাজকন্যাকে কয়েক শ নৌবহরের পাহারায় পাঠানো হয় সুলু রাজ্যের রাজার সঙ্গে বিয়ে দিতে। ওদিকে ব্রুনাইয়ের তৎকালীন সুলতান রাজকন্যা দায়াং আয়েশাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। তার সঙ্গে বিয়ে না দেওয়ার অপমান ভুলতে এবং সুলু রাজার সঙ্গে আয়েশার বিয়ে মেনে নিতে না পেরে আরও বড় নৌবহর নিয়ে জোহর রাজ্যের নৌবহরে আক্রমণ করে রাজকন্যাকে তুলে নিয়ে যান এবং বিয়ে করেন। আর এদিকে বিপদে পড়ে কয়েক শ বাজাউ ও তাদের পরিবার। দেশে ফিরলেই নিশ্চিত মৃত্যু, তাই প্রাণের ভয়ে আর দেশে ফিরতে পারেনি তারা। স্থলের সঙ্গে চিরকালের জন্য বিচ্ছেদ হয় তাদের। তখন থেকেই সমুদ্র তাদের ঘরবাড়ি ও দেশহীন জীবন।

আরব বেদুইন
বেদুইনদের মরুভূমি সম্পর্কে অসাধারণ পাণ্ডিত্ব এবং এর নাড়িনক্ষত্র সম্পর্কে ধারণার থাকায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের রাষ্ট্রীয় সীমান্ত পাহারায় আরব বেদুইনদের নিয়োজিত রেখেছে
বেদুইন কথাটা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে তপ্ত মরুর বালির ওপর হাতে অস্ত্র নিয়ে টকবগিয়ে ছুটে চলা এক যোদ্ধার ছবি। আরব বেদুইন ৩ হাজার বছর ধরে যাযাবর জীবনযাপন করা এক পশুপালক গোষ্ঠী। ঐতিহ্যগতভাবে যাদের বসবাস আরব উপদ্বীপ, উত্তর আফ্রিকা ও লেভান্টের মরুভূমিতে। বেদুইন আরবি শব্দ ‘বেদু’ থেকে এসেছে। যার অর্থ মরুভূমির বাসিন্দা। এদের ‘আরাবা’ বলেও অভিহিত করা হয়। অনেক গোত্র আছে তাদের। যেমন- তাইবা, বানু, হিলাল, হামিদা ইত্যাদি। বিভিন্ন কৌশল আয়ত্ত করে বালুঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে এই জাতি। ঘোড়া চালাতেও খুব পারদর্শী তারা। যাতায়াতের সুবিধার জন্য পাথুরে পাহাড়ে খোদাই করে দিকনির্দেশনা দেয়। পাহাড় ও তাঁবু খাটিয়ে মরুভূমিতে বসবাস তাদের এবং বাবা-মা, ভাই-বোন একসঙ্গে এক তাঁবুতে বসবাস করে তারা। বর্তমানে অনেক বেদুইন স্থায়ীভাবে বিভিন্ন শহরে বাস করে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে নিয়োজিত। ফলে বেদুইনদের সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন। এক সময় বেদুইনরা পানির উৎস ও চারণভূমি নিয়ে এক গোত্র অন্য গোত্রকে আক্রমণ ও বণিকদের মালামাল লুট করত। রক্তের বদলে রক্ত, হত্যার বদলে হত্যা এবং হত্যাকারীকে না পেলে পরিবারের অন্যদের হত্যা করাই ছিল রীতি। তবে বেদুইন সমাজ শক্তিশালী সম্মানবোধের ভিত্তিতে গঠিত। ফলে গোত্রের প্রতি তারা খুব অনুগত এবং প্রবল একতাবদ্ধ। মিথ্যা প্রমাণ করতে ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ‘শিবা বা আগুনের’ পরীক্ষা তাদের ঐতিহ্যগত রীতি। নির্দিষ্ট ধর্ম না থাকায় একসময় দেবদেবীর মূর্তিকে তারা পূজা করত। পরবর্তীকালে এক ঈশ্বরবাদ ধর্মের সূত্রপাত হয়। হজরত মুহাম্মদ (সা:) ইসলাম প্রচার করার পর বেদুইনরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। মরুভূমির রুক্ষতা থেকে বাঁচতে ও শীতকালে শরীর উষ্ণ রাখতে বেদুইন নারী-পুরুষ সবাই সাদাসিধা ঢিলেঢালা লম্বা পোশাক ও আলখেল্লা পরে। মাথায় স্কার্ফ ও আগলা করে বাঁধা এক ধরনের টুপি পরে যা তাদের ধুলা ও রোদ থেকে রক্ষা করে। বেদুইনরা কলহপ্রবণ জাতি হিসেবে পরিচিত হলেও নাচ, গান ও আরব্য উপভাষায় কবিতা রচনা বেশ উপভোগ করে। রাতে মরুর উষ্ণতা শূন্যে নামলে আগুন জ্বালিয়ে তারা খোশগল্পে মেতে ওঠে। রুটি, মাংস, দুগ্ধজাত খাবার তাদের প্রধান খাদ্য। বেদুইনদের মরুভূমি সম্পর্কে অসাধারণ পাণ্ডিত্ব এবং এর নাড়িনক্ষত্র সম্পর্কে ধারণার থাকায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের রাষ্ট্রীয় সীমান্ত পাহারায় আরব বেদুইনদের নিয়োজিত রেখেছে।