নিউইয়র্কে একটি ‘কালচারাল সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২৩ নভেম্বর নিউইয়র্কে বসবাসরত নাট্যকলা, চারুকলা, নৃত্যকলা, সংগীত ও আবৃত্তিসহ বিভিন্ন শাখার প্রায় ৫০জন শিল্পীর উপস্থিতিতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজক ছিল কৃষ্টি, যার সার্বিক সমন্বয় করেন কৃষ্টির নির্বাহী প্রধান নাট্যজন সীতেশ ধর এবং সঞ্চালনা করেন নাট্যজন ও চলচ্চিত্র নির্মাতা মাস্উদ সুমন।
বাংলা ভাষা, স্বাধীনতা, সাহিত্য ও শিল্প-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা পালনকারি এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের নাট্যচর্চার বিকাশে অন্যতম পথিকৃৎ দেশবরেণ্য নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ ছিলেন প্রধান অতিথি।
স্থায়ী একটি কালচারাল সেন্টারের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে মামুনুর রশীদ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের বহু শিল্প-সংস্কৃতির মানুষ নিউইয়র্কে বাস করছেন। একইসাথে নিউইয়র্কে জন্ম নিচ্ছে নতুন প্রজন্মের শিল্পী এবং নির্মিত হচ্ছে সৃজনশীল দর্শকগোষ্ঠী। নিউইয়র্ক একটি বহুজাতিক, বহু-ভাষাভাষী বিশ্বসংস্কৃতির কেন্দ্র, যেখানে শিল্পচর্চার সুযোগ বিস্তৃত হলেও বাংলা শিল্প-সাহিত্য চর্চার জন্য একটি স্থায়ী অবকাঠামোর অভাব দীর্ঘদিন অনুভূত হচ্ছে। নিয়মিত মহড়া, প্রদর্শনী, ক্লাস, কর্মশালা, সৃজনশীল আড্ডা ও উৎসব আয়োজনের মতো মৌলিক কর্মকাণ্ডের জন্য পরিপূর্ণ সুবিধাসম্পন্ন নিজস্ব জায়গা অর্থাৎ একটি কালচারাল সেন্টার প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। ‘কালচারাল সেন্টার’ হলে প্রবাসে বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরদের বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করানো এবং শিল্পীদের সৃজনশীল কর্মপরিসর নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
মামুনুর রশীদ বলেন, নিউইয়র্ক যেহেতু বিশ্বের বিভিন্ন জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের আবাসস্থল, এখানে শিল্পচর্চার পরিসর স্বভাবতই বহুমাত্রিক। বাংলা ভাষা ও শিল্পকে আন্তর্জাতিক পরিসরে আরও উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরতে হলে অন্যান্য ভাষা ও সংস্কৃতির শিল্পচর্চার সঙ্গে সৃজনশীল ফিউশনের সুযোগ প্রসারিত করা জরুরি। বাংলা ভাষা, সংগীত, নৃত্য, নাটক, কবিতা ও চারুকলার বহুজাতিক মেলবন্ধন প্রবাসী এবং আন্তর্জাতিক দর্শকদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা ও নান্দনিক উপহার তৈরি করতে পারে। এই ধরনের ফিউশন শুধু শিল্পকে সমৃদ্ধ করবে না, বরং সংস্কৃতির মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং বন্ধনও আরও দৃঢ় করবে।
মামুনুর রশীদ উল্লেখ করেন, এর ফলে প্রতিদিনের বাংলা সংস্কৃতি চর্চা, প্রশিক্ষণ, মঞ্চনির্ভর শিল্পকলা বিকাশ ও প্রজন্মান্তরে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ রক্ষার স্বার্থে একটি স্থায়ী ‘কালচারাল সেন্টারের বিকল্প নেই। এই লক্ষ্য অর্জনে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার পথরেখা নির্ণয় করতেই এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে।
বাংলাদেশে জীবনভিত্তিক নাট্যচর্চার ইতিহাস প্রসঙ্গে প্রবীণ এই অভিনেতা আরো বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ব্রিটিশ কাউন্সিল, রাশিয়ান কালচারাল সেন্টার, মহিলা সমিতি, গাইড হাউজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট একসময় নাটকের প্রধান কেন্দ্র ছিল। নাট্যকর্মীদের দীর্ঘ আন্দোলন ও প্রচেষ্টার ফলেই প্রতিষ্ঠিত হয় তিনটি মিলনায়তন, মহড়া কক্ষ, সেমিনার রুম, লাইব্রেরি, সভাকক্ষ সমৃদ্ধ জাতীয় নাট্যশালা, সেখানে যেমন প্রসেনিয়াম থিয়েটারের চর্চা হচ্ছে, একইভাবে ঐতিহ্যবাহী বাংলা-নাটকের আঙ্গিকে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সৃজনশীলতা ও গবেষণামূলক নাটকের কাজও হচ্ছে।
বরেণ্য সংগীতশিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, নাট্যব্যক্তিত্ব মুজিব-বিন-হক, নাট্যজন রোকেয়া রফিক বেবী, শামসুল আলম বকুল, লুৎফুন নাহার লতা, খাইরুল ইসলাম পাখি, আর্টিস্ট ফোরামের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, উদীচীর সাধারণ সম্পাদক ড. জীবন বিশ্বাস, বাঙালী পত্রিকার সম্পাদক কৌশিক আহমেদ, সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা লাবলু আনসার, নিউজার্সিস্থ সুচনা থিয়েটারের কর্ণধার জান্নাতুল টুম্পা, নাট্যজন সুলতান বোখারী, মেহজাবীন মুমু, সুমি, চুমকি, কামাল, তামান্না, প্রীতি, বসু, পলক, দীপা, শাফি, কাজল সংগীতশিল্পী মুক্তা ধরসহ অনেকে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
সভায় দীর্ঘ আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়, পরবর্তীতে নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ, তহবিল সংগ্রহ, শিল্পমোদী মানুষদের সম্পৃক্তকরণ এবং অন্যান্য সম্ভাবনা নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। সকলের অভিমত, প্রবাসে বাংলা সংস্কৃতির ধারাবাহিক বিকাশ নিশ্চিত করতে এই কালচারাল সেন্টার ভবিষ্যতে একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে।
এ সভা শেষে কালচারাল সেন্টারের প্রত্যাশা পূরণে ‘ডিজিটাল সিগনেচার ক্যাম্পেইন’ কার্যক্রম শুরু করা হয় নাট্যজন মামুনুর রশীদের স্বাক্ষরের মাধ্যমে। এসময় তিনি নিউইয়র্কে বসবাসরত সকল বাঙালিকে এই ক্যাম্পেইনে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন