সেপ্টেম্বর থেকে ক্যারিবিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় আমেরিকা প্রায় দুই ডজন হামলা চালিয়েছে, যাতে ৮০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সর্বশেষ হামলায় চারজন নিহত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করেছে, লক্ষ্যবস্তু নৌকাগুলোতে মাদক বা চোরাচালানকারী ছিল। কিন্তু এ দাবির স্বপক্ষে তারা কোনো প্রমাণ তুলে ধরেনি।
ভেনেজুয়েলা উপকূলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি, আর দুই দেশের উত্তপ্ত বাকযুদ্ধ দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে। শঙ্কা, সংশয় আর আশার মিশ্রণে ভেনেজুয়েলাবাসী এখন বিভক্ত। কেউ বিদেশি শক্তির আগমনকে সম্ভাব্য মুক্তি হিসেবে দেখছেন, কেউ দেখছেন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের ওপর আঘাত হিসেবে। মাতৃভূমিকে রক্ষায় কেউ আবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ৫২ বছর বয়সি কৃষক ও ব্যবসায়ী ডেভিড ওরোপেজা বলেন, ‘মাতৃভূমি তো মাতৃভূমিই, আর আমাদের সেনাবাহিনী আমাদেরই বাহিনী।’ ওরোপেজা নিজেই ফল সংগ্রহ করে ফ্রোজেন স্ট্রবেরি ও ব্ল্যাকবেরি বিক্রি করেন। স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে তাকে সপ্তাহে তিনবার চিকিৎসা নিতে হয়। তবুও যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলায় হামলা করলে তিনি লড়াইয়ে যেতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন। ‘ওদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ ময়দানে নামতে আমি প্রস্তুত। আগ্রাসনকারীদের মুখোমুখি হব ভেনেজুয়েলার সেনাদের সঙ্গে দাঁড়িয়েই,’ আলজাজিরাকে বলেন ওরোপেজা। ডাউনটাউন কারাকাসে বাসের অপেক্ষায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ৫২ বছর বয়সি এই কৃষক-ব্যবসায়ী বলেন, ‘যেভাবে পারি দেশের জন্য সাহায্য করব।’
অজানার ভয়ে ভেনেজুয়েলা : অজানা ভয়ে ভেনেজুয়েলাবাসী। সন্তানকে নিয়ে পার্কে এসে ৩৪ বছর বয়সি গৃহিণী দালিবেথ ব্রেয়া বললেন, এই পরিস্থিতি তার মনে আশা ও শঙ্কা দুয়েরই উদ্রেক করে। এ উদ্বেগ, উত্তেজনা তার পারিপার্শ্বিক সামাজিক পরিম লেও বাস্তব। তার এক বন্ধু সরকারি চাকরিতে আছেন। চাকরিতে বিরূপ প্রভাব পড়ার ভয়ে তিনি এ বিষয়ে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হননি। ব্রেয়া মনে করেন, ভেনেজুয়েলা যে চাপের মুখে পড়েছে তা দেশের জন্য ভালো কিছুও বয়ে আনতে পারে। তার কথায়, ‘বাইরের দেশগুলোতে যে উন্নয়ন দেখি, সেটা এখানে হলে ভালো লাগবে।’ তবে সহিংসতার সম্ভাবনা ব্রেয়াকে আতঙ্কিতও করেছে। কৃষক ও ব্যবসায়ী ওরোপেজার মতো শত্রুবাহিনীকে রুখে দাঁড়ানোর মনোভাব তার নেই; বরং লুকিয়ে থাকারই প্রবণতা। ‘ভয়ে আমি আশ্রয় নিতাম,’ স্বীকার করেন তিনি। তার প্রস্তুতি খুব সাধারণ : ‘বাড়িতে খাবার জমা রাখা, আর সবাইকে এক জায়গায় রাখা।’ ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা শহরটিতে সূর্য ডুবতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে ব্রেয়ার মুখে শোনা যায় অন্য লাখো মানুষের মতোই অনিশ্চয়তার সুর। ‘আমি জানি না কিছু ঘটবে কি না,’ বলেন তিনি। ‘কিছু ক্ষেত্রে মনে হয় হবে- আবার কিছু ক্ষেত্রে মনে হয় হবে না।’
‘ইতিবাচক পরিবর্তন’ : সেপ্টেম্বর থেকে ক্যারিবিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র প্রায় দুই ডজন হামলা চালিয়েছে, যাতে ৮০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সর্বশেষ হামলায় চারজন নিহত হন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করেছে, লক্ষ্যবস্তু নৌকাগুলোতে মাদক বা চোরাচালানকারী ছিল। কিন্তু এই দাবির স্বপক্ষে তারা কোনো প্রমাণ তুলে ধরেনি। নৌযানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের দিকে যাচ্ছিল এমন কোনো প্রমাণও ট্রাম্প প্রশাসন দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র নৌযানগুলোতে হামলা চালানোর কোনো আইনি যৌক্তিকতাও তুলে ধরেনি। যদিও অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, এসব হামলা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। এর মধ্যেই ট্রাম্প আবার এ কথাও বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র স্থলভাগে মাদক চোরাচালানকারীদের ওপর হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মানে ভেনেজুয়েলার মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সামরিক অভিযান খুব শিগগিরই চলতে পারে এমন আভাসই মেলে। ট্রাম্প সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে ভেনেজুয়েলার কাছে ক্যারিবীয় অঞ্চলে বিশ্বের সবচেয়ে বগ বিমানবাহী রণতরী ইউএএস গেরাল্ড আর ফোর্ড মোতায়েন করেছে। সঙ্গে মোতায়েন হয়ে হাজার হাজার সেনা এবং এফ-৩৫ জঙ্গিবিমানও। কয়েক দশকের মধ্যে ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের এমন শক্তি প্রদর্শন আর দেখা যায়নি। ভেনেজুয়েলাবাসীদের কেউ কেউ মনে করেন, প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই চাপ দেশের জন্য ভালো। এক ভেনেজুয়েলাবাসীর কথায়, যুক্তরাষ্ট্রের এ চাপের কারণে ‘ভেনেজুয়েলা মুক্ত হবে। আমাদের মুক্তির দিন আসবে।’ মাদুরো এখনই অনেক চাপ অনুভব করছেন- এমনটিই মনে করেন বলে জানান তিনি। তার কথায় মাদুরোর শাসন ঘিরে ভেনেজুয়েলাবাসীর মধ্যে ব্যাপক হতাশারই প্রতিফলন ঘটেছে। জানুয়ারিতে তৃতীয় মেয়াদে ভেনেজুয়েলার ক্ষমতা নেওয়া মাদুরোর শাসনামলে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংকটই কেবল আরও গভীর হয়েছে। -রয়টার্স