২০২৫ সাল শেষ হতে চলেছে। কিন্তু ঢাকাই ছবির খরা কাটেনি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রের ব্যর্থতা এ কথার প্রমাণ দেয়। এই ৯ মাসে মুক্তি পেয়েছে মোট ২৭টি চলচ্চিত্র। দর্শক সাড়া পেয়েছে মাত্র পাঁচটি ছবি। এগুলো হলো- ‘বরবাদ’, ‘জংলি’, ‘দাগি’, ‘তাণ্ডব’ ও ‘উৎসব’। তাও আবার এই পাঁচটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে দুই ঈদে। মানে উৎসবে মুক্তি পেয়েছে বলেই দর্শক বরাবরের মতো ঈদে বিনোদন পেতে সিনেমা হলে এসেছে বলে ছবিগুলো কিছুটা সাফল্যের মুখ দেখেছে। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া ছবিগুলো হলো- জানুয়ারি : ‘মধ্যবিত্ত’- নির্মাতা তানভীর হাসান, অভিনয়ে মাসুম আজিজ, ওমর মালিক, এলিনা শাম্মী, শিশির সরদার। ‘মেকাপ’, নির্মাতা অনন্য মামুন, অভিনয়ে তারিক আনাম খান, জিয়াউল রোশান, নিপা আহমেদ। ‘কিশোর গ্যাং’-নির্মাতা আবদুল মান্নান, অভিনয়ে নীলিমা ইসলাম মুন, আয়ান সজিব, ইশতিয়াক আহমেদ সাদ। ‘রিকশা গার্ল’ নির্মাতা অমিতাভ রেজা, অভিনয়ে নভেরা আহমেদ। ফেব্রুয়ারি : ‘বলী’, নির্মাতা ইকবাল হোসাইন চৌধুরী, অভিনয়ে নাসির উদ্দিন খান। ‘দায়মুক্তি’, নির্মাতা-বদিউল আলম খোকন, অভিনয়ে সাইমন সাদিক। ‘জলে জ্বলে তারা’-নির্মাতা অরুণ চৌধুরী, অভিনয়ে মিথিলা, এফ এস নাঈম, ফজলুর রহমান বাবু। ‘ময়না’, নির্মাতা মনজুরুল ইসলাম মেঘ, অভিনয়ে-রাজ রিপা, কায়েস আরজু, আমান রেজা, আফফান মিতুল। মার্চ : ‘বরবাদ’, নির্মাতা-মেহেদী হাসান হৃদয়, অভিনয়ে-শাকিব খান, ইধিকা পাল, মিশা সওদাগর। ‘জংলি’-নির্মাতা-এম রহিম, অভিনয়ে- সিয়াম আহমেদ, বুবলী। ‘দাগি’, নির্মাতা-শিহাব শাহীন, অভিনয়ে-আফরান নিশো, তমা মির্জা, সুনেরাহ বিনতে কামাল। ‘চক্কর ৩০২’, নির্মাতা শরাফ আহমেদ জীবন। অভিনয়ে-মোশাররফ করিম। ‘জ্বীন ৩’, নির্মাতা-কামরুজ্জামান রোমান। অভিনয়ে-সজল নূর, নুসরাত ফারিয়া। ‘অন্তরাত্মা’- নির্মাতা-ওয়াজেদ আলী সুমন। অভিনয়ে-শাকিব খান, দর্শনা বণিক। এপ্রিল মাসে কোনো ছবি মুক্তি পায়নি। মে : ‘জয়া আর শারমিন’, নির্মাতা-পিপলু খান। অভিনয়ে-জয়া আহসান। ‘আন্তঃনগর’-নির্মাতা-গোলাম রাব্বানী কিশোর, অভিনয়ে-শান্ত চৌধুরী, তমা, সুব্রত। জুন : ‘তাণ্ডব’, নির্মাতা-রায়হান রাফী, অভিনয়ে-শাকিব খান। ‘নীলচক্র’ নির্মাতা-মিঠু খান, অভিনয়ে-আরিফিন শুভ, মন্দিরা চক্রবর্তী। ‘উৎসব’ নির্মাতা-তানিম নূর, অভিনয়ে-জাহিদ হাসান, জয়া আহসান। ‘ইনসাফ’ নির্মাতা সঞ্জয় সমাদ্দার, অভিনয়ে-মোশাররফ করিম, তাসনিয়া ফারিণ, শরিফুল রাজ। ‘এশা মার্ডার : কর্মফল’, নির্মাতা সানী সানোয়ার, অভিনয়ে-আজমেরী হক বাঁধন। ‘টগর’ নির্মাতা-অলক হাসান, অভিনয়ে-আদর আজাদ, পূজা চেরী। জুলাই : ‘অন্যদিন’-নির্মাতা- কামার আহমাদ সাইমন। ‘আলী’ নির্মাতা-বিপ্লব হায়দার, অভিনয়ে- ইরফান সাজ্জাদ। আগস্ট : ‘উড়াল’ নির্মাতা -জোবায়দুর রহমান, অভিনয়ে- মাহফুজ মুন্না, সোহেল তৌফিক, শান্ত চন্দ্র। ‘জলরঙ’ নির্মাতা-কবিরুল ইসলাম রানা, অভিনয়ে- সাইমন সাদিক। সেপ্টেম্বর : ‘আমার শেষ কথা’, নির্মাতা- কাজী মোহাম্মদ ইসলাম মিয়া।

চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, ঢাকাই ছবি না চলার অন্যতম কয়েকটি কারণ হলো- শক্তিশালী গল্প ও চরিত্রের অভাব, জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পীদের অনুপস্থিতি, উচ্চ প্রোডাকশন ভ্যালুর অভাব, কার্যকর মার্কেটিং কৌশল নেই এবং উৎসবের সময় ছাড়া মানসম্মত ছবির মুক্তি নেই। লায়ন সিনেমাসের কর্ণধার মির্জা খালেক বলেন, মানসম্মত ছবি নির্মাণ হচ্ছে না। পর্যাপ্ত ছবিও নেই। দর্শক যে ধরনের গল্প আর গানের ছবি চায়, যা দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করে, পরিবার নিয়ে সিনেমা হলে গিয়ে দেখতে চায় তারও অভাব। এতে দর্শক দেশীয় ছবির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে এবং সিনেমা হলগুলো দর্শকশূন্য হয়ে পড়েছে। বেশ কিছু সিনেমা হলের পরিবেশ উন্নত করা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির সাউন্ড সিস্টেম ও প্রজেক্টর স্থাপন করা হয়েছে। তার পরও মানসম্মত ছবি নেই বলে দর্শকের অভাবে সিনেমা হল ভেঙে তাতে মার্কেট তৈরি করতে বাধ্য হচ্ছেন মালিকরা। সরকারি অনুদানে যে ছবি নির্মাণ করা হয় তা টেলিফিল্মের মতোই। দর্শক সেগুলো দেখে না। দর্শক বাণিজ্যিক ঘরানার ছবি দেখতে চায়। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস বলেন, ২০০২ সাল থেকে যখন সিনেমা হল বন্ধ হওয়া শুরু হয়েছে তখন থেকেই প্রদর্শক সমিতির কর্মকর্তারা চিৎকার করে আসছি। কিন্তু কূম্ভকর্ণের ঘুম আর ভাঙে না। অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রতিযেগিতাহীন বাজারে পণ্যের মান ভালো হয় না। প্রতিযোগিতাবিহীন যেনতেন ছবি নির্মাণ করলেই দর্শক দেখবে এটি নির্মাতাদের ধারণা। এ ধারণায় নির্মিত কিছু ছবি দর্শক প্রথম দিকে দেখলেও পরে একঘেয়েমির কারণে তা বর্জন করেছে। নীতিমালা ছাড়াই ১৯৯৯ সাল থেকে স্যাটেলাইট চ্যানেলে সেন্সরবিহীন ভারতীয় ছবি প্রদর্শন চলছে। একই ছবি বৈধভাবে আমদানি করে সিনেমা হলে প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। এ বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে স্যাটেলাইট চ্যানেলের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হয়েছে সিনেমা হলকে। ফলে মানসম্মত ছবি ও দর্শকের অভাবে লোকসান দিয়ে বন্ধ হচ্ছে সিনেমা হল। এরপরও একশ্রেণির চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলী ভারতীয় ছবি আমদানি করলে তাদের রুটি-রুজি বন্ধ হয়ে যাবে অযৌক্তিক দাবি জানালেও নিজেরাও মানসম্মত ছবি নির্মাণ করতে পারছেন না। তাদের অভিযোগের তীর শুধুই প্রদর্শক সমিতি আর সিনেমা হলের পরিবেশের দিকে। তর্কের খাতিরেই প্রশ্ন করতে চাই, তাহলে সাম্প্রতিক সময়ের ব্যবসা-সফল ছবিগুলো প্রদর্শনের সময় সিনেমা হলের পরিবেশ কি আপনাআপনি ঠিক হয়ে গেল? প্রদর্শকরা অনুভব করে কারিগরি উৎকর্ষতার এই যুগে আধুনিক প্রযুক্তি ও দর্শকের আরামের ব্যবস্থা করা ব্যবসায়িক স্বার্থেই প্রয়োজন। কিন্তু দেড় যুগ ধরে মানসম্মত ছবির অভাবে লোকসান গুনে সিনেমা হল সংস্কার কীভাবে সম্ভব? এজন্য ছবি আমদানি এবং বিদেশি ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গিয়ে মানসম্মত ছবি নির্মাণ করলে হল মালিকরা দর্শক পেয়ে ঋণ করে হলেও সব সিনেমা হল আধুনিক করতে সাহস পাবে এবং সিনেমা হল বন্ধ রোধ ও নতুন সিনেমা হল নির্মাণ শুরু হবে। চলচ্চিত্র গবেষক, সাংবাদিক অনুপম হায়াৎ বলেন, প্রযুক্তিগত, নির্মাণগত, প্রতিভাগত ও ঐক্যের সংকট শিল্পটির অস্তিত্ব সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এখন স্বল্প খরচে নেটে দেশি-বিদেশি ছবি দেখা যায়। সবার হাতে হাতে রয়েছে মোবাইল। তাই সহজেই সিনেমা দেখার ব্যবস্থা এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। এতে প্রকারান্তরে সিনেমা হলে যাওয়ার প্রবণতা কমেছে।
তা ছাড়া মানসম্মত ছবি নির্মাণ ও সিনেমা হলের সুন্দর পরিবেশ দুঃখজনক হারে কমেছে। নিজস্ব সংস্কৃতির গল্পে ছবি বানাতে হবে। তাতে দর্শক সিনেমা হলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়েছেন। চলচ্চিত্র একটি যৌগিক শিল্প। এর পরিবেশও যৌগিক হতে হবে। অব্যবস্থাপনা ও অনৈক্য এই শিল্পের অধঃপতন ডেকে আনছে। একসময় এ শিল্পে মধ্যস্বত্বভোগী বলে কোনো পক্ষ ছিল না। হঠাৎ এ পক্ষের উদ্ভবের কারণে প্রযোজককে প্রতি মুহূর্তে তাদের হাতে নাকাল হতে হচ্ছে। এমনিতেই চলচ্চিত্রের ব্যবসা মন্দা। তার ওপর যদি একটি পক্ষ অযৌক্তিকভাবে প্রযোজকের কাছ থেকে বিশাল টাকার অঙ্ক হাতিয়ে নেয় তাহলে প্রযোজককে তো পথে বসতেই হবে। নিয়ম হচ্ছে পণ্য উৎপাদনকারী সরাসরি তার পণ্য বাজারজাত করবে। এখানে তৃতীয় পক্ষের কি দরকার। এরা কাদের সৃষ্টি। চলচ্চিত্রের সব পক্ষ মিলে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক জুনায়েদ হালিম বলেন, সিনেমা হলের ব্যবসা এখন অলাভজনক হয়ে পড়েছে। দেখার উপযোগী ছবি হচ্ছে না। আগে বক্তব্যধর্মী ছবি নির্মাণ কারা হতো। সুস্থধারার ছবিও তেমন তৈরি হচ্ছে না। ফলে দর্শকদের ওপর সিনেমা হলে না যাওয়ার দায় চাপানো যাবে না। যানজট ঠেলে সময় আর অর্থ নষ্ট করে কেন সিনেমা হলে ছবি দেখতে যাবে। আগে ছবি দেখার জন্য সিনেমা হল ছিল একমাত্র স্থান। এখন মোবাইল ফোন, নেট, স্যাটেলাইট চ্যানেলসহ নানা মাধ্যমে নানা ছবি দেখা যায়। এতে বড়পর্দায় ছবি দেখার মজা না পেলেও মিনি ফরম্যাটে দেখে পরিতৃপ্ত হচ্ছেন। মানে প্রযুক্তিগত কারণে যন্ত্রপাতি, দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ও অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটছে। মানুষ এখন ঘোরের মধ্যে আছে। এই ঘোর কাটাতে সিনেমা হলের সুন্দর পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। মাল্টিপ্লেক্সে চার-পাঁচটি স্ক্রিন থাকছে তাতে ভিন্ন ভিন্ন মুভি চলছে। এতে দর্শক তার রুচিমতো ছবি বাছতে পারছেন। এখানেও মাল্টিপ্লেক্স বাড়ানো দরকার। সিনেপ্লেক্স নির্মাণের জন্য সরকার যদি ঋণ দেয় বা প্রাইভেট খাতেও সিনেপ্লেক্স নির্মাণ বৃদ্ধি করা যায়, তাহলে বিনোদনের জন্য এটি হবে একটি রেভ্যলুশন।