রাজপরিবারে বধূ হওয়ার আগে ডায়ানাকে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। যুবরাজ চার্লসের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের সময়ে ডায়ানা প্রশ্ন তুলেছিলেন, পুরুষের কেন সতীত্ব পরীক্ষা করা হয় না তা নিয়ে। ডায়ানার বিচ্ছেদে তাঁর কোনো অপরাধ ছিল না। ছিল যুবরাজের। যুবরাজের পরকীয়ার কারণে ডায়ানার বিচ্ছেদ হলেও গৃহত্যাগী হতে হয়েছিল ডায়ানাকেই। সতীত্ব নিয়ে কথা হলে শরৎবাবুর অচলা, পৌরাণিক কাহিনি দ্রৌপদির প্রসঙ্গ উঠতে পারে। আমরা সেদিকে যাব না। আমাদের বিষয় আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রশ্ন হচ্ছে, এ নির্বাচনে যারা রেফারি এবং রেফারি টিমের ভূমিকায় থাকবেন তাদের একটি সুষ্ঠু স্বচ্ছ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়ার মতো যোগ্যতা, দক্ষতা এবং আন্তরিকতা আছে কি না। কথা এ কারণে যে, সশস্ত্র বাহিনী দিবসে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। গণতান্ত্রিক উত্তরণ বিষয়টি নির্ভর করে আন্তরিকতার ওপর। এদিকে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, নির্বাচনের সময় প্রায় ১ লাখ সেনা, ৩৫ হাজার নৌবাহিনী, ৫ হাজার কোস্টগার্ড, ৮ হাজার র্যাব এবং সাড়ে ৫ লাখের মতো আনসার বাহিনী থাকবে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হতে তিনটি বড় বাধা দেখছেন পর্যবেক্ষকরা। ১. অবৈধ অস্ত্র ২. নাশকতা ৩. দলীয় কোন্দল। এর সবই মূলত শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিপরীতে অবস্থান করে।
আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতায় এখন জোর হাওয়া বইছে। নির্বাচন নিয়ে জোট গঠন, প্রার্থী মনোনয়নের তুমুল ব্যস্ততার খবর বেরোচ্ছে পত্রপত্রিকায়। বিএনপি ইতোমধ্যে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করে আবার তা পুনঃমূল্যায়ন করছে বলে বলা হচ্ছে। জামায়াতের পক্ষ থেকে আরও একধাপ এগিয়ে পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণের আয়োজন চলছে। সে বিবেচনায় বলা যায়, নির্বাচনের জন্য যে তিন শরিক তার এক অংশের দৃশ্যমান প্রস্তুতি চলছে। নির্বাচনের মূল শক্তি জনগণ। কারণ তাদের ভোট প্রদান ও সঠিক ফলাফল নিশ্চিত করাই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মূল কথা। এ কাজটি গত সাড়ে ১৫ বছরে করা যায়নি বলেই যত কথার উৎপত্তি। এবার এটি করার উদ্যোগ চলছে। এটি করতে হলে জনগণের মধ্যে আস্থার সংকট দূর করতে হবে। জনগণ ভোট দিতে পারলে একটি প্রধান বাধা দূর হবে। এখানেই মূল আলোচনা। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী নিয়ে যে বিবাদ তার জের কতটা নির্বাচনের মাঠে পড়বে সেটি এক্ষুনি নিশ্চিত করে বলা না গেলেও অনুমান করা যায় এটি বড় ধরনের হুমকিতে রয়েছে। নির্বাচনের আগেই প্রচুর সহিংস ঘটনা ঘটছে এবং তাতে মৃত্যুর খবরও বেরোচ্ছে। অন্যদিকে চিহ্নিত হত্যা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে এ ধরনের টার্গেট কিলিং চলছে। যে কারণেই হোক হত্যার ঘটনা বাধাহীনভাবেই চলছে। এর সঙ্গে মব ভায়োলেন্সের বিষয় তো রয়েছেই। প্রকাশিত খবর বলছে, ৫ আগস্টের পর পুলিশের ৫ হাজার ৭৬৩টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লাখ ৫৪২ হাজার ৮টি গুলি লুট হয়। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৪২৩টি উদ্ধার হয়েছে। মাঠে আছে ১ হাজার ৩৪০টি। ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচনের সময়ে সীমান্ত দিয়ে আরও অস্ত্র প্রবেশ করতে পারে। সে বিবেচনায় অবৈধ অস্ত্রের ঝুঁকি কতটা মারাত্মক হতে পারে সে আলোচনা বোধকরি না বললেও চলে। এখানে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, ভোট কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বিবরণী অনুযায়ী নির্বাচনের মাঠে কোনো পুলিশ বাহিনী থাকছে না। এর আগে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছিলেন, পুলিশের আস্থা অর্জনের সময় হচ্ছে আসন্ন নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে ব্যতিক্রম হচ্ছে, সেনাবাহিনীর কাছে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকা। অবশ্য এ নিয়েও নানা কথা রয়েছে। বলা হচ্ছে, সিভিল প্রশাসন পরিচালনায় মূলত সেনাবাহিনীর কোনো প্রশিক্ষণ নেই। সে কারণে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে ইতোমধ্যেই। যা হোক, নির্বাচনে কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ একটি বড় বিষয় হলেও এটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের একমাত্র বিষয় নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, কেন্দ্রে গোলযোগ হয়েছে এমন কেন্দ্রের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তার অর্থ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে তা নয়। নির্বাচনি কেন্দ্র হচ্ছে দৃশ্যমান বিষয়। নির্বাচনের আসল বিষয় হচ্ছে রেফারির সিদ্ধান্ত। এযাবৎকাল যে ক’টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার মধ্যে বিতর্কিত অংশ রয়েছে যারা নির্বাচন পরিচালনা করেন তাদের নিয়ে। এবারও এ বিতর্কের বাইরে নেই। ইতোমধ্যে জামায়াতের একজন প্রার্থীর বক্তব্যে তোলপাড় হচ্ছে। প্রসঙ্গ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। এ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে ফলাফলের জন্য। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এবারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এক বিশেষ পরিস্থিতিতে। এমন এক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যখন গোটা জাতি মুখিয়ে আছে নির্বাচনের জন্য। ব্যাপারটি গত সাড়ে পনের বা তারও বেশি সময়ে ভোট হচ্ছে না সে জন্যই নয়। বাংলাদেশ এক কঠিন সময় পার করছে। গত ৫৪ বছরের বিবেচনায় বলা যায়, ওয়ান-ইলেভেন ছাড়া দীর্ঘ সময়ের দুর্বৃত্তায়িত শাসনের পর এতটা সময় পর্যন্ত দেশ কখনো অনির্বাচিত সরকারের অধীনে থাকেনি। বিএনপি অনেক অগেই নির্বাচনের জন্য তাগিদ দিচ্ছিল। বিষয়টিকে অনেকে ভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের জানা উচিত ছিল, অনির্বাচিত সরকার মূলত দৈনন্দিন কাজের বাইরে কিছু করতে পারে না। এবার যারা নির্বাচন করছে তাদের মধ্যে বিএনপিই অভিজ্ঞ দল। সংসদ গণতন্ত্র নিয়ে তাদের সমকক্ষ অন্য কেউ নেই। অথচ তারা কথা বললেই কোনো কোনো মহল নানা ব্যাখ্যা করে। সে যাই হোক। এখন এমন এক সময় নির্বাচন হচ্ছে যখন ইতোমধ্যেই অনেক মৌলিক প্রশ্নের উদয় হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, সরকারের ভিত্তি নিয়ে। আর এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার আপাত কোনো ফয়সালা নেই যতক্ষণ না নির্বাচন হয়।
বাংলদেশে যে ক’টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে স্বচ্ছ বলা হয় রাজনৈতিক জোটের প্রস্তাবিত তত্ত্বাবধায়কের অধীনে অনুষ্ঠিত ’৯১ সালের নির্বাচন। ওই নির্বাচনে বিএনপি ও তাদের জোট বিজয়ী হয়েছিল। নির্বাচনি ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ বলল, নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে। যদিও কোথায় কীভাবে হয়েছে তার কোনো বিবরণ তারা দেয়নি এবং শপথও নিয়েছিল। কথা সেটি নয়, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারছে না দলগতভাবে। কোনোভাবে অংশ নেবে কি না সেটি ভিন্ন বিষয়। তবে এ বিষয় যে ঝুঁকিপূর্ণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে বিবেচনায় রেফারির সতীত্ব বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ের বাহিনীর বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য। শুরু করছি একটি উদাহরণ দিয়ে। ১/১১ সরকার যখন ক্ষমতাসীন হয় তখন বিএনপির শেষ দিকে হওয়া বিসিএস পরীক্ষার পুনঃ ভাইভা নেয়। কারণ তারা প্রশাসনকে তাদের ভাষায় বিএনপিমুক্ত করতে চেয়েছিল। এ নিয়ে উচ্চ আদালতের রায় এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। ’৭২ সালে ভারতীয়দের পরামর্শে প্রশাসনে ভাইভার মাধ্যমে যে ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তাদের একজন ছিলেন বিতর্কিত তিন নির্বাচনের একটির প্রধান নির্বাচন কমিশনার। জনতার মঞ্চ করে তারা বিএনপি সরকার হটানোর আন্দোলনে ছিল। এরশাদ যখন বিএনপি সরকার হটিয়ে সামরিক শাসন দেন তখন নতুন ক্যাডার নিয়োগ করা হয়। গত সাড়ে ১৫ বছর এসব ক্যাডারই দেশ দাপিয়ে বেড়িয়েছে। নির্বাচন নিয়ে যত জোচ্চুরি বদমায়েশি সব কিছুর সঙ্গে এরা জড়িত। এরা আষ্টেপৃষ্ঠে দূষিত। কার্যত এরা জনগণের কোনো কল্যাণ কাজে ব্যবহৃত হয়েছে কি না বলা মুশকিল। এসব সরকার আমলাদের সেবার পরিবর্তে নির্যাতন শিখিয়েছে। এর বাইরেও কথা রয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে ইসলামী ব্যাংক বা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়োগের বিরাধিতা করা হচ্ছে।
নির্বাচন নিয়ে যে মেরুকরণ শুরু হয়েছে সময় যত এগোবে তাতে নানা পরিবর্তন স্থান করে নেবে। এবারের নির্বাচন নিঃসন্দেহে এক জটিল সমীকরণে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। একে শুধু একটি নির্বাচন বললেই শেষ হয়ে যায় না বরং গভীর বিবেচনায় দেখার রয়েছে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রধান সংকট যদি ফ্যাসিবাদ হয় তাহলে বলতে হবে সেটি নির্বাচনের কারচুপি দিয়েই প্রবেশ করে। ’৭৩-এর নির্বাচনে কারচুপির ফল বাকশাল। ২০০৮ সালে নির্বাচনে কারচুপির ফল গত সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদের নির্যাতন নিষ্পেষণ। আর এ নির্বাচনের সফলতা-ব্যর্থতা শুধু আনুষ্ঠানিক বিষয় নয় বরং এর সঙ্গে রয়েছে নৈতিক সম্পর্ক। নির্বাচন একটি পবিত্র আমানত। বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামোর অধীনে এবারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ বাস্তবতায় অতীতের জোচ্চুরির সঙ্গে যুক্তদের দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা মাঠপর্যায়ে মারাত্মক বিপদ ডেকে আনবে বা আনতে পারে। একটা কথা না বললেই নয়, আসলে আমাদের মতো দেশের অধিকাংশ মানুষই ক্ষমতার পায়রাবি করতে ভালোবাসে। ক্ষমতায় কে আসছে তার হয়ে বা তাদের সন্তুষ্ট করার এক হীনমন্যতা আমাদের অনেকের মধ্যেই রয়েছে। সে কারণেও চাকরিতে থাকা বা মোসাহেবিতে পারঙ্গমদের এবারের নির্বাচনি দায়িত্বে রাখা বোধকরি সংগত হবে না। নির্বাচনের দুটি অংশ। যদি বাইরের অংশ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সাহসের জোগান দেওয়া যায় তাহলে ভিতরের কাজ কঠিন নয়। দেশের অবসরে যাওয়া সামরিক-বেসামরিক আমলাদের অফিস আছে। সেখানে তাদের সদস্যদের তালিকাও রয়েছে। এদের চাওয়াপাওয়ার হিসাব কম। জীবনে সব কিছু শেষে এখন আর মোহবিষ্ট হওয়ার কথা নয়। এদের থেকে আগ্রহী যোগ্য দক্ষদের বেছে নেওয়া যেতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এবারের আগস্ট অভ্যুত্থানে এদের অনেকেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এটিই একমাত্র বিষয় তা নাও হতে পারে। মূল কথা হচ্ছে, একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভাষায় রেফারির ভূমিকা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। মূলত বিখ্যাত ফুটবলার ম্যারাডোনার সেই বিখ্যাত উক্তির কথা স্মরণ করুন, এ যদি হাত হয় তাহলে সেটি ঈশ্বরের হাত। আসলে রেফারির সিদ্ধান্তহীনতাই ছিল মূল বিষয়। ফলাফল ঘোষণার দায়িত্ব রেফারির। গোল দিলেও তা বাতিল হয়ে যায় রেফারির সিদ্ধান্তের কারণে। যেভাবে বিচারপতি ফাঁসি দিলে তার কোনো বিচার হয় না। লাইসেন্সপ্রাপ্ত ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা গেলে ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলা হয় না। আসন্ন নির্বাচনের আগে সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন এটাই জনপ্রত্যাশা।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক