মানুষের জীবন একটি উন্মুক্ত বই নয়; এটি এক রহস্যময় পাণ্ডুলিপি, যার পাতাগুলোতে ভেসে আছে অগণিত সুখদুঃখের ছোঁয়া, আশা আর হতাশার অমিল, জয় আর পরাজয়ের অদৃশ্য কাব্য। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত, যেন সেই পাণ্ডুলিপির অচিন্তিত অক্ষর, যা শুধু অভিজ্ঞ চোখই পড়তে পারে। কখনো হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসে আনন্দের সোনালি আলো, আবার কখনো অন্ধকারে ঢেকে যায় মননশীলতার সূক্ষ্ম রং। জীবন যে শুধু দেখা যায় বা শোনা যায় এমন এক সরল গাথা নয়, তা আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি স্বপ্নে, প্রতিটি ব্যর্থতায় অস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
কিন্তু সেই পাণ্ডুলিপি সবার চোখের সামনে খুলে রাখলে কী হয়? পাঠকেরা হয়তো মুগ্ধতার বদলে সমালোচনার ছুরি চালাবে, আনন্দের বদলে শুধু বিচারের অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। তাই প্রাচীন প্রবাদ আমাদের স্মরণ করিয়েছে- ‘কাউকে বলবেন না আপনার অতীতের ভুল, বর্তমানের সংকট আর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা।’ এ এক বাক্যেই নিহিত মানবজীবনের গভীর প্রজ্ঞা, যা শিখিয়ে দেয়, কেমনভাবে আমাদের নিজের অন্তর্দৃষ্টি ও অভিজ্ঞতাকে লালন করতে হয়, অন্যের চোখের বিচারের দিকে নয়। আমরা সবাই ভুল করি- এটি মানুষের এক অবিচ্ছেদ্য সত্য। কখনো আবেগের ঝড়ের তাপে, কখনো অজ্ঞতার অন্ধকারে, আবার কখনো পরিবেশ ও পরিস্থিতির অচল প্রভাবে। আমাদের ছোট ছোট ভ্রান্তি, অনিচ্ছাকৃত ভুল, যেন জীবনের সেই অদৃশ্য পাঠ, যা প্রথমে ব্যথা ও লজ্জা বয়ে আনে, কিন্তু পরে বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার আলো ছড়িয়ে দেয়।
দুঃখজনক সত্য হলো, এই ভুল যখন অন্যের কানে তুলে ধরা হয়, তখন তা লজ্জার বেড়ে ওঠা আঘাতের রূপ নেয়। অনেকে আমাদের অতীতের ক্ষুদ্র ভ্রান্তিকে শিক্ষা নয়, বরং অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আঘাত করার জন্য। ঠিক এ কারণে অতীতের ভুল কখনো প্রকাশের বিষয় নয়; বরং তা থেকে শিক্ষার চুম্বকীয় শক্তি আহরণ করাই প্রকৃত প্রজ্ঞার পরিচয়।
ইতিহাস সাক্ষী- যারা নিজেদের ভ্রান্তি লুকিয়ে রেখেছেন নয়, বরং ধীরে ধীরে তার গভীর অর্থ উপলব্ধি করে সংশোধন করেছেন, তারাই পরিণত হয়েছেন মহৎ মানুষে। এই শিক্ষা আমাদের শেখায় যে ভুল কেবল লজ্জার নয়, বরং আত্মসংশোধন ও নৈতিক বৃদ্ধির পথপ্রদর্শক। অতীতের ভুলের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি যখন লজ্জা থেকে শিক্ষা ও প্রজ্ঞার দিকে স্থানান্তরিত হয়, তখনই জীবনের পাণ্ডুলিপি সমৃদ্ধ ও গভীর হয়ে ওঠে।
সংকট হলো জীবনের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী, যা কখনো ধীরে, কখনো হঠাৎ প্রবেশ করে আমাদের দিনের আলোছায়ায়। অর্থনৈতিক চাপের অচিন্তিত ভার, পারিবারিক দ্বন্দ্বের সূক্ষ্ম দাগ, মানসিক অস্থিরতার অমিল- এসবই মানুষের চলার পথের অদৃশ্য কণ্টক। সংকট আমাদের শুধু পরীক্ষা দেয় না, বরং প্রজ্ঞার এক মৃদু আলো দেখায়, যা দৃঢ়তার নিদর্শন হতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, যখন আমরা নিজের অস্থিরতা ও দুর্বলতার কাহিনি অন্যের কাছে খুলে বলি, তখন সবাই হয়তো সহানুভূতির মুখোশ পরায়, তবু অন্তরে অনেকেই তুচ্ছতাবোধ করে। কেউ কেউ এই দুর্বলতাকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করে, আর আমরা বুঝতে পারি মানুষের সহানুভূতির মুখোশ সব সময় সত্যিকারের সহানুভূতির প্রতীক নয়।
এ কারণেই বর্তমানের অন্ধকারকে নিঃশব্দে বুকের ভিতর ধারণ করে লড়াই চালিয়ে যাওয়া প্রায়ই একমাত্র পথ হয়ে ওঠে, যা আত্মমর্যাদা রক্ষার সাহস দেয়। সংকটকে উচ্চারণ করার মধ্যে নয়, বরং সহ্য করার মধ্যেই জন্ম নেয় অদম্য শক্তি, যা আমাদের অভ্যন্তরীণ জোর ও প্রজ্ঞার প্রকাশ। এই শক্তিই জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়, অন্ধকারের মাঝেও আলো খুঁজে বের করার যোগ্যতা শেখায়।
মানুষ স্বপ্ন দেখে, চায় নিজের জীবনকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে, ভবিষ্যতের জন্য সূক্ষ্ম পরিকল্পনা গড়ে তোলে। কিন্তু এই পরিকল্পনা যদি অকালেই অন্যের কানে পৌঁছায়, তবে তা হয়ে ওঠে ঝঞ্ঝা-হিংসাবিদ্বেষ বা অপচেষ্টার অদৃশ্য বুলডোজার, যা ধীরে ধীরে স্বপ্নের পথকে ব্যাহত করে। অনেক স্বপ্নই ভেঙে যায় অন্যের ঈর্ষার আঁচলছোঁয়ায়, আর সেই ভাঙন শুধু ক্ষত নয়, তা হয়ে ওঠে নীরব হাহাকার, যা নিজের অন্তরকেও স্তব্ধ করে দেয়।
প্রকৃতপক্ষে ফুলের কুঁড়ি যখন ফুটতে থাকে, তখন যদি কেউ আগেভাগে তা ছিঁড়ে ফেলে, তার সৌরভ আর ছড়িয়ে পড়তে পারে না। তেমনি, আমাদের স্বপ্ন ও পরিকল্পনাগুলোও নীরবে লালন করতে হয় মননের গভীরে, চুপচাপ যত্নের সঙ্গে, যতক্ষণ না তা বাস্তবের মঞ্চে প্রস্ফুটিত হয়ে নতুন আলো ছড়িয়ে দেয়। নীরবতা এই ক্ষেত্রে কোনো নিস্পৃহতা নয়; বরং এটি একটি সংরক্ষণ, একটি আত্মনিরীক্ষা, যা স্বপ্নকে শক্তিশালী করে, বাস্তব রূপে উন্মোচনের জন্য প্রস্তুত করে। এই নীরব লালনের মধ্যেই জন্ম নেয় স্থির প্রজ্ঞা, যা আমাদের জীবনের পথকে দৃঢ়তা ও সমৃদ্ধি দান করে এবং শেখায় ভবিষ্যতের সোনালি কল্পনাও নিঃশব্দে বেড়ে ওঠে, যখন তা সব অনাকাঙ্ক্ষিত চোখের বাইরে থাকে।
লেখক : আইনজীবী