জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানির (এসএমসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী তসলিম উদ্দিন খান বলেন, বাংলাদেশে দ্রুত বেড়ে চলেছে এইচআইভি/এইডসের ঝুঁকি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শনাক্তের হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ার পাশাপাশি নিম্নমানের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য নতুন হুমকি তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, গুণগত মানহীন কনডম শুধু গর্ভনিরোধ ব্যাহত করে না, বরং এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি এবং অন্যান্য যৌন রোগ (এসটিআই) ছড়ানোর ঝুঁকিও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
তসলিম উদ্দিন খান বলেন, বাংলাদেশ বহু বছর তুলনামূলক নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকলেও হঠাৎ করে এইচআইভি শনাক্তের হার বাড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৭ হাজার এইচআইভি পজিটিভ মানুষ আছে। শুধু এ বছরই ১ হাজার ২০০ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা উদ্বেগজনক। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর আকার বড় এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর পরিস্থিতি আমাদের ওপরও চাপ সৃষ্টি করছে।
এইডস সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তিনি প্রবাসী শ্রমিকদের ঝুঁকি, যৌনকর্মী, ইনজেক্টেবল ড্রাগ ব্যবহারকারী এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সামাজিক অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে দায়ী করেন। এ ছাড়াও রোহিঙ্গা শরণার্থী জনগোষ্ঠীর মধ্যে আক্রান্তের সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় ঝুঁকি মূল্যায়ন যথাযথভাবে করা যাচ্ছে না বলেও জানান তিনি।
তসলিম উদ্দিন খান বলেন, তিনটি উপায়ে এইচআইভি ছড়ায় : প্রথম মা থেকে সন্তান। দ্বিতীয়ত অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক এবং দূষিত রক্ত বা ইনজেক্টেবল ড্রাগ শেয়ার। অনেকেই ভুল করে মনে করেন কাউকে সুস্থ দেখালেই সে ঝুঁকিমুক্ত। এ ধারণাকে বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাহ্যিক চেহারা দেখে কখনো বোঝা যায় না একজন ব্যক্তি এইচআইভি বহনকারী কি না।
এসএমসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বাংলাদেশে নিম্নমানের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী এবং নকল কনডম এখন এইচআইভি ঝুঁকি বাড়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে উঠছে। এসব কনডমে নিম্নমানের ল্যাটেক্স ব্যবহার হয়, লুব্রিকেন্ট নিরাপদ নয়, অনুপযুক্ত প্যাকেজিংয়ের কারণে ফেটে যাওয়া বা লিকেজের ঝুঁকি থাকে। ফলে এসটিআই, এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
তিনি আরও বলেন, নিম্নমানের কনডম ব্যবহার করলে গর্ভনিরোধও ব্যর্থ হতে পারে, রোগ প্রতিরোধ ব্যাহত হয়। কিছু ক্ষেত্রে সংক্রমণ ও ত্বকের জ্বালা, ইনফেকশন, ক্যান্ডিডিয়াসিসের মতো জটিলতাও দেখা দেয়। হেল্থ কমপ্লায়েন্স ছাড়াই উৎপাদিত কনডম এখন বাজারে কম দামে সহজলভ্য হয়ে পড়েছে। এটিই সবচেয়ে বিপজ্জনক।
তসলিম উদ্দিন খান জানান, বাংলাদেশে কনডম ব্যবহারের ক্ষেত্রে এসএমসি দীর্ঘদিন ধরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। বাজারের প্রায় ৭২ শতাংশ কনডম এসএমসির ব্র্যান্ডগুলো পূরণ করছে, যা মাননির্ভরতার প্রমাণ।
তিনি বলেন, এসএমসির কনডম ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদিত। বাজারে যেসব নকল বা মানহীন কনডম মিলছে, সেগুলোর সঙ্গে এসএমসির কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা সবাইকে অনুরোধ করব এসএমসির লোগো দেখে কনডম কিনুন। সেটাই নিরাপত্তার সার্টিফিকেট।
এইচআইভি প্রতিরোধে দেশের ১৩৭টি উপজেলায় কমিউনিটি মোবিলাইজেশন কার্যক্রম পরিচালনা করছে এসএমসি। এ কার্যক্রমে বিবাহের আগে রক্ত পরীক্ষা বিষয়ে প্রচারণা, এইচআইভি, এসটিআই, হেপাটাইটিস বি সম্পর্কে সচেতনতা, কমিউনিটিতে গ্রুপ মিটিং, উঠান বৈঠক কার্যক্রম চলমান।
অতীতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় (ট্রাকস্ট্যান্ড, পতিতালয়, বন্দর) কনডম বিতরণ ও কাউন্সেলিং পরিচালনার কথাও উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, আমাদের এ উদ্যোগ একসময়ে দেশের এইচআইভি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
তসলিম উদ্দিন খানের মতে, যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে সমাজে গভীর নীরবতা ও ভুল ধারণা রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার বা কর্মস্থল কোথাও যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয় না। তাই কনডম কিনতে গেলেও সংকোচ কাজ করে। কিন্তু লজ্জার কারণে কনডম ব্যবহার না করলে তার পরিণতি সারা জীবনের জন্য ভয়াবহ হতে পারে। এসএমসির কনডম সহজে ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছাতে সারা দেশে ২ লাখের বেশি ফার্মেসিতে পণ্য পৌঁছানো হচ্ছে।
আজ বিশ্ব এইডস দিবস। এ বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্লোগান ‘বাধা অতিক্রম করি, এইডস প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় রূপান্তর আনি।’ তসলিম উদ্দিন খানের মতে, এ প্রতিপাদ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে- সচেতনতা, তথ্য প্রাপ্তি ও মানবিক সহায়তা সবই এখনো সমান গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, যৌন স্বাস্থ্য লজ্জার বিষয় নয়। অনিরাপদ সম্পর্ক, নকল কনডম বা ভুল ধারণার কারণে জীবন ঝুঁকিতে ফেলা উচিত নয়। আমরা প্রত্যেকে সচেতন হলে বাংলাদেশ একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে পারবে। তাই অনিরাপদ যৌন মিলন এড়িয়ে চলার পাশাপাশি নিম্নমানের কনডম ব্যবহার থেকে বিরত থাকা এবং সরকার অনুমোদিত ব্র্যান্ড (এসএমসির কনডম) ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়াও যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা, প্রয়োজনে এইচআইভি পরীক্ষা করানো, বিদেশ যাওয়া বা ফিরে আসার ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়ান এবং ইনজেক্টেবল ড্রাগ ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে সূচ শেয়ার বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়েছেন তসলিম উদ্দিন খান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমণ বাড়ছে এবং নিম্নমানের কনডম এখন নতুন ঝুঁকির উৎস। মানসম্মত জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং সামাজিক ট্যাবু কাটানো- দুটিই জরুরি। জনগণের সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা বাড়লে এইডস প্রতিরোধ করা সম্ভব এটাই তার মূল বার্তা।