সীমান্তবর্তী জেলা যশোরে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে এইচআইভি সংক্রমণ। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ সংক্রমণের হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৪০ জনের বেশি এইচআইভিতে সংক্রমিত হয়েছেন, যার মধ্যে ২৫ জনই শিক্ষার্থী। শুধু যশোরেই নয়, এইচআইভি সংক্রমণ এবং এইডস আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা দেশে উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে। নতুন শনাক্ত রোগী, মৃত্যু ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর বিস্তৃতি নিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নতুন করে সতর্কতা দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আজ বিশ্ব এইডস দিবস পালন করা হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সব বাধা দূর করি, এইডসমুক্ত সমাজ গড়ি’। দেশে এইচআইভি সংক্রমণের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত দুই দশকের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে এবং দ্রুতগতিতে বেড়েছে। ২০০০ সালে যেখানে মাত্র ৩১ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল, ২০২৪ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৩৮ জনে। অর্থাৎ দুই দশকের ব্যবধানে শনাক্ত বৃদ্ধি প্রায় ৪৬ গুণ। আরও জানা যায়, ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সংক্রমণের বৃদ্ধি তুলনামূলক ধীর ছিল। ২০০৫ সালে শনাক্ত হয় ১৯৩ জন এবং ২০১০ সালে ৩৪৩ জন। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে শনাক্তের হার দ্রুত বাড়তে থাকে। ২০২০ সালে শনাক্ত হয় ৬৫৮ জন, ২০২১ সালে ৭২৯ জন, ২০২২ সালে ৯৪৭ জন, ২০২৩ সালে ১ হাজার ২৭৬ জন। এ ধারাবাহিক বৃদ্ধি ইঙ্গিত করে যে, দেশে সংক্রমণ ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টা কাক্সিক্ষত সফলতা পায়নি।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই ৮৮২ নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের সংখ্যা গত বছরের রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এটি স্পষ্ট করে যে, সংক্রমণ শনাক্তকরণের প্রবণতা কমছে না; বরং পরীক্ষার পরিধি বৃদ্ধির পাশাপাশি বাস্তব সংক্রমণও বাড়ছে। তথ্য অনুযায়ী, মৃত্যুর হারও ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বমুখী ছিল। ২০০০ সালে একজনের মৃত্যু হয়েছিল, ২০০৫ সালে ৩০ জন, ২০১০ সালে ৩৭ জন এবং ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২৬ জনে। এতে বোঝা যায়, চিকিৎসার প্রসার বৃদ্ধি পেলেও উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ ও মৃত্যু উভয়ই উদ্বেগজনক মাত্রায় রয়েছে। ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এইচআইভি রোগী শনাক্তের পর থেকেই বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জোরদার হয়। গত এক দশকে বৈশ্বিক পর্যায়ে আক্রান্তের সংখ্যা ৪০ শতাংশ এবং মৃত্যু ৫৬ শতাংশ কমেছে। ২০০০ সালে বিশ্বব্যাপী নতুন এইচআইভি সংক্রমণ ছিল প্রায় ২৯ লাখ এবং মৃত্যু ১৮ লাখ। কিন্তু গত বছর তা কমে যথাক্রমে ১৩ লাখ ও ৬ দশমিক ৩ লাখে দাঁড়ায়।
এ বৈশ্বিক অগ্রগতির বিপরীতে বাংলাদেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
গত দশ বছরে দেশে এইচআইভি পরীক্ষার পরিধি চোখে পড়ার মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬ সালে যেখানে পরীক্ষা হয়েছিল মাত্র ৮৩ হাজার ৩৫৬ জনের, গত বছর সেই সংখ্যা ১৬ দশমিক ১২ লাখে পৌঁছেছে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার অংশ হিসেবে অতিরিক্ত আরও ১০ দশমিক ৩৪ লাখ মানুষ এইচআইভি পরীক্ষা করিয়েছেন।
পরীক্ষা বৃদ্ধির ফলে এখন সংক্রমিত ব্যক্তিদের অনেকেই শনাক্ত হচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সম্ভাব্য আক্রান্তদের ৭৭ শতাংশ বর্তমানে তাদের সংক্রমণ সম্পর্কে জানেন। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে এ হার ৯৫ শতাংশে উন্নীত করার আন্তর্জাতিক লক্ষ্য অর্জন এখনো কঠিন।
গত বছরের জুনে টিবি-এল অ্যান্ড এএসপি কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হওয়ায় দেশে প্রতিরোধমূলক সেবায় বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটে। এখন নির্দিষ্ট কেন্দ্রে এইচআইভি পরীক্ষা ও চিকিৎসা চালাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিদেশি দাতাদের ওপর নির্ভর করছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, অর্থ সংকটের কারণে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী যেমন ইনজেকশন ড্রাগ ব্যবহারকারী, নারী যৌনকর্মী, ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা প্রতিরোধমূলক সেবার পূর্ণ কাভারেজ পাচ্ছেন না। ২৫টি জেলায় এ জনগোষ্ঠী এখনো কার্যকর সেবার বাইরে রয়েছে বলে জানা গেছে।
মূল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৩ দশমিক ২২ লাখ এবং গত বছর শনাক্ত হওয়া মোট রোগীর অর্ধেকই এ গোষ্ঠী থেকে এসেছে। তারা আক্রান্ত হলেও জানা ছিল না। পরীক্ষা বাড়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রণীত একটি নতুন উন্নয়ন প্রকল্প বর্তমানে অনুমোদনের অপেক্ষায়। অনুমোদন পেলে প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি পুনরায় নির্বিঘ্নভাবে চালানো সম্ভব হবে বলে প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। দেশে বর্তমান আক্রান্ত ও মৃত্যুর চিত্র বিষয়ে জানা যায়, দেশে প্রথম এইচআইভি রোগী শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। গত বছর পর্যন্ত দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৪২২ জন। যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৪১২ জনের।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরীক্ষার বিস্তার ও অর্থায়নের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা না গেলে সংক্রমণ আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিরোধমূলক সেবা জোরদার করার ওপর জোর দিয়েছেন তারা। দেশে সরকারিভাবে এইডসের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। বেসরকারি পর্যায়ে এ সেবা নেওয়ার সুযোগ এখনো নেই। এইডস শনাক্ত করার জন্য সারা দেশে ২৭টি কেন্দ্র রয়েছে আর চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় ১৩টি কেন্দ্র থেকে। তবে এসব রোগী ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে শুধু মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের। গতকাল হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে ১২ জন রোগী ভর্তি আছেন।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আরিফুল বাশার বলেন, ‘ইদানীং পুরুষ সমকামী এবং বিদেশফেরত শ্রমিকদের মধ্যে বেশি এইডস শনাক্ত হচ্ছে। শনাক্তকৃত রোগীদের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সি বেশি। এইডস রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হলেও জটিল রোগীদের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিভিন্ন মেডিকেল থেকে এ হাসপাতালে এলেও অনেক ল্যাবরেটরি সুবিধা, অস্ত্রোপচার ব্যবস্থা, এইচআইভি রোগের তীব্রতা পরিমাপের জন্য (অপরচুনেসটিক ইনফেকশন), এমআরআই, বায়োপসি ও সিডি ফোর কাউন্টের মতো ব্যয়বহুল পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। রোগীদের বিভিন্ন ধরনের ফাঙ্গাল ইনফেকশন ও বিভিন্ন প্যারাসাইটিক রোগ হলেও নির্ণয়ের ব্যবস্থা নেই। রোগীদের ডায়ালাইসিস নেই। জনবল সংকটে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া কঠিন হয়। এ ছাড়া অ্যাডভান্স লেভেলের অ্যান্টিবায়োটিকও সরবরাহ নেই।’
যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সংক্রমিত ও আক্রান্ত হওয়া ৪০ জনের মধ্যে ২৩ জন পুরুষ এবং ১৪ জন নারী। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো- আক্রান্তদের মধ্যে ২৫ জনই শিক্ষার্থী। উদ্বেগজনক হারে সিরাজগঞ্জে বাড়ছে এইচআইভি পজিটিভ রোগীর সংখ্যা। জেলায় ২৫৫ জন পজিটিভ রোগী পাওয়া গেছে।