থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্তে বহুদিন ধরে চলা উত্তেজনা আবারও চরমে উঠেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় করা নাজুক যুদ্ধবিরতি চুক্তিও কার্যত ভেঙে পড়েছে। সোমবার থেকে কয়েকজন থাই সেনা নিহত ও আহত হওয়ার পাশাপাশি সাতজন কম্বোডিয়ান বেসামরিক নাগরিক হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। দুই পক্ষই আগুন লাগানোর অভিযোগ করছে একে অপরের বিরুদ্ধে।
সীমান্তে থাইল্যান্ডের বিমান হামলার পর সংঘর্ষ আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। জুলাইয়ের যুদ্ধবিরতির পর এটিই সবচেয়ে গুরুতর পরিস্থিতি। ওই সময় পাঁচ দিনের সংঘর্ষে অন্তত ৪৮ জন নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। এরপর মালয়েশিয়ার সহায়তায় ট্রাম্প দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নেন। তিনি যেটিকে কুয়ালালামপুর শান্তি চুক্তি বলে অভিহিত করেন, সেটি অক্টোবরে স্বাক্ষরিত হয়। তবে থাইল্যান্ড এটিকে যৌথ ঘোষণা হিসেবে উল্লেখ করে। স্বাক্ষরের মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় থাইল্যান্ড চুক্তি স্থগিত করে এবং ডিসেম্বরেই নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয়।
এই বিরোধ নতুন নয়। ফরাসি দখলদারিত্বের পর সীমান্ত নির্ধারণ ঘিরে শত বছরের পুরোনো বিবাদ এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। ২০০৮ সালে কম্বোডিয়া বিতর্কিত এলাকার একটি একাদশ শতকের মন্দিরকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে নিবন্ধন করার উদ্যোগ নিলে উত্তেজনা তীব্র হয়। বছরের পর বছর ধরে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে দুই দেশের সেনা ও সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে।
সর্বশেষ উত্তেজনা শুরু হয় মে মাসে, যখন সংঘর্ষে এক কম্বোডিয়ান সেনা নিহত হয়। এতে দুই দেশের সম্পর্ক এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছায়। জুলাইয়ের সংঘর্ষের আগে উভয় দেশই সীমান্তে নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কম্বোডিয়া থাইল্যান্ড থেকে ফল ও সবজি আমদানি এবং বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সেবা গ্রহণ বন্ধ করে দেয়। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সীমান্তে উভয় দেশই সেনা মোতায়েন বাড়ায়।
এবারের সংঘর্ষ নিয়ে দুই পক্ষের বক্তব্য ভিন্ন। থাই সেনাবাহিনীর দাবি, কম্বোডিয়ার গুলির জবাব দিতে বাধ্য হয়েছিল তারা এবং কম্বোডিয়ান সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালানো হয়েছে। তাদের অভিযোগ, কম্বোডিয়ার গুলিতে উবন রাচাথানি প্রদেশে এক থাই সেনা নিহত হয়েছে। তবে নমপেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রথমে থাইল্যান্ডই প্রেহ ভিহেয়ার প্রদেশে আক্রমণ চালায়। কম্বোডিয়ার দাবি, তারা পাল্টা আক্রমণ করেনি।
পরদিন থাইল্যান্ড অভিযোগ করে, কম্বোডিয়া রকেট সিস্টেম, বোমাবাহী ড্রোন ও আত্মঘাতী ড্রোন ব্যবহার করেছে, যার কিছু রকেট বেসামরিক এলাকায় আঘাত হেনেছে। অপরদিকে কম্বোডিয়ার অভিযোগ, থাইল্যান্ড নির্বিচারে পুরসাত প্রদেশের বেসামরিক এলাকাগুলোতে গুলি চালিয়েছে।
জুলাইয়ের সংঘর্ষেও দুই পক্ষ একে অপরকে দায়ী করেছিল। থাইল্যান্ডের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের ভাষ্য, কম্বোডিয়া প্রথমে সীমান্তে নজরদারির জন্য ড্রোন ব্যবহার করে এবং রকেটচালিত গ্রেনেড হাতে সেনারা জড়ো হয়। পরে তারা গুলি চালালে থাই সেনারা পাল্টা আক্রমণ করে। অন্যদিকে কম্বোডিয়ার দাবি ছিল, থাই সেনারা প্রথমে একটি মন্দিরে প্রবেশ করে কাঁটাতারের বেড়া বসায় এবং এরপর আগাম গুলি চালায়।
ট্রাম্পের শান্তি চুক্তিও স্থগিত হয়ে যায় নভেম্বরেই। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী আনুতিন চার্নভিরাকুল জানান, নিরাপত্তা হুমকি কমেনি। কম্বোডিয়া জানায়, তারা এখনো চুক্তির শর্তে অটল। ব্যাংককের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিহাসাক ফুয়াংকেতকেও বলেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হচ্ছে না এবং দায় কম্বোডিয়ার। তবে কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেন বলছেন, তাদের বাহিনী কেবল পাল্টা গুলি চালিয়েছে।
অক্টোবরে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তিতে ভারী অস্ত্র প্রত্যাহার ও একটি অন্তর্বর্তীকালীন পর্যবেক্ষক দল গঠনের কথা ছিল। পরবর্তী ধাপে থাইল্যান্ডে আটক ১৮ জন কম্বোডিয়ান সেনাকে মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল।
পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। অতীতে দ্রুত উত্তেজনা কমে এলেও এখন দুই দেশের নেতৃত্বে এমন শক্ত অবস্থান দেখা যাচ্ছে, যা সমঝোতার পথকে কঠিন করে তুলছে। ইতিমধ্যে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ব্রিটিশ ফরেন অফিস জানিয়েছে, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে প্রয়োজন ছাড়া ভ্রমণ না করাই ভালো।
সূত্র বিবিসি বাংলা
বিডি প্রতিদিন/আশিক