এ যেন কোনও জনপ্রিয় হলিউড চলচ্চিত্র বা ওয়েব সিরিজের চিত্রনাট্য, যেখানে শত্রু দেশের অত্যাধুনিক লড়াকু জেট ‘চুরি’ করে পালাবে এক দুঃসাহসী গুপ্তচর! কিন্তু কোনও কল্পকাহিনি নয়। গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে জীবন বাজি রেখে এমনই এক রুদ্ধশ্বাস অভিযান চালায় ইসরায়েলের গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদ, যা আরব দুনিয়ার যাবতীয় হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছিল। ঘটনার এক বছরের মাথায় বিখ্যাত ছ’দিনের যুদ্ধে ত্রিমুখী জোটকে হেলায় হারিয়ে দিতে তাই কোনও সমস্যা হয়নি ইসরায়েলের।
ইহুদিদের ওই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন ডায়মন্ড’। ১৯৬৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে যা শুরু করে ইসরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ। এতে সাফল্য আসে ১৯৬৬ সালের ১৬ অগস্ট। ইরাকি বিমানবাহিনীর থেকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) তৈরি মিগ-২১ লড়াকু জেট উড়িয়ে নিজেদের ঘাঁটিতে নিয়ে আসে তারা। এই ‘চুরি’তে তেল আবিবের পাশাপাশি সুবিধা পেয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। মস্কোর তৈরি যুদ্ধবিমানটির শক্তি এবং দুর্বলতা সংক্রান্ত যাবতীয় খুঁটিনাটি হস্তগত করে ওয়াশিংটন।
১৯৫৯ সালে সাবেক সোভিয়েত বিমানবাহিনীতে শামিল হয় মিগ-২১ লড়াকু জেট। কর্মজীবনের গোড়াতেই ভিয়েতনাম যুদ্ধে (১৯৫৫-’৭৫ সাল) শক্তি প্রদর্শন করে মস্কোর ওই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। এর সঙ্গে আকাশের লড়াইয়ে মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলো এঁটে উঠতে পারেনি। ফলে অস্ত্রের বাজারে হু-হু করে বাড়তে থাকে মিগ-২১-এর কদর। ১৯৬১-’৬২ সালের মধ্যেই ক্রেমলিনের সাধের জেটটি আমদানি করে ফেলে একাধিক উপসাগরীয় আরব দেশ। ফলে প্রমাদ গোনে ইসরায়েল।
উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোকে মিগ-২১ সরবরাহের নেপথ্যে তৎকালীন সোভিয়েত নেতৃত্বের ছিল অন্য ছক। ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘ঠান্ডা লড়াই’য়ে জড়িয়ে পড়ে সোভিয়েত। ফলে পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন প্রভাব কমাতে মরিয়া হয়ে ওঠে ক্রেমলিন। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ ‘বন্ধু’ হিসেবে পরিচিত ইহুদিদের বিপদ বাড়াতে বিন্দুমাত্র দেরি করেনি তারা। ছক কষেই আরব দুনিয়ায় দেদার অস্ত্র বিক্রি করতে থাকেন সোভিয়েত নেতৃত্ব, যে তালিকায় ছিল মিগ-২১ জেটও।
মস্কোর এই বিপজ্জনক নীতি আঁচ করে নিতে ইহুদিদের বেশি সময় লাগেনি। ততদিনে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী বিমানবাহিনী তৈরি করে ফেলেছে ইসরায়েল। ফলে লড়াইয়ের গোড়াতেই শত্রুর আকাশ দখল করে ফেলার চাবিকাঠি ছিল তাদের হাতে। সেই সুবিধা হারিয়ে ফেললে তেল আবিব যে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়বে, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি তৎকালীন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়েনের। আর তাই গুপ্তচরবাহিনী মোসাদকে শত্রুর ঘরে সিঁদ দিয়ে মিগ-২১ চুরির নির্দেশ দেন তিনি।
ওই সময়ে আরব দুনিয়ার দু’টি দেশের বিমানবাহিনীর বহরে ছিল মিগ-২১। তার মধ্যে একটি হল ইসরায়েলের প্রতিবেশী মিসর। আর তাই সোভিয়েত জেটটিকে চুরি করতে প্রথমে ‘পিরামিডের দেশ’কেই পাখির চোখ করে মোসাদ। এই কাজের দায়িত্ব জিন থমাস নামের এক এজেন্টকে দেয় ইহুদিদের গুপ্তচরবাহিনী। আদিব হান্না নামে কায়রোর এক লড়াকু জেট পাইলটের সঙ্গে খুব দ্রুত যোগাযোগ করে ফেলেন তিনি। ১০ লাখ ডলার ঘুষের বিনিময়ে মিগ-২১কে ইসরায়েলে উড়িয়ে নিয়ে যেতে রাজি হন আদিব।
থমাস যখন অভিযানের জাল গুটিয়ে এনেছেন, তখনই বিশ্বাসঘাতকতা করে বসেন ওই মিসরীয় পাইলট। ইহুদিদের যাবতীয় পরিকল্পনা কায়রোর সরকারের কাছে ফাঁস করে দেন তিনি। আদিবের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, থমাস-সহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে ‘পিরামিডের দেশের’ পুলিশ। বিচারে মৃত্যুদণ্ড হয় তাদের। এর পর ইসরায়েলি গুপ্তচরদের ফাঁসিতে ঝোলাতে দেরি করেননি তৎকালীন মিসরীয় প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের।
মিসরে অভিযান ব্যর্থ হলেও হতোদ্যম হয়নি মোসাদ। বরং ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন উদ্যমে কাজে লেগে পড়ে তারা। ‘পিরামিডের দেশ’ থেকে মিগ-২১ ‘চুরি’ করা একরকম অসম্ভব বুঝতে পেরে এবার ইরাকের দিকে নজর ঘোরায় ইসরায়েলি গুপ্তচরবাহিনী। বাগদাদ বিমানবাহিনীর দু’জন পাইলটকে এই কাজের জন্য বিপুল অর্থের লোভ দেখানো হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে রাজি হননি তারা। ফলে ভেস্তে যায় তেল আবিবের দ্বিতীয় প্রচেষ্টাও।
‘অপারেশন ডায়মন্ড’-এর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে ব্রিটিশ সাংবাদিক গর্ডন থমাসের লেখা ‘গিডিয়ান’স স্পাইস’ নামের বইতে। তার দাবি, পরপর দু’বার ব্যর্থ হয়ে মোসাদ যখন কোনও কূলকিনারা পাচ্ছে না, ঠিক তখনই দেবদূতের মতো প্যারিসের দূতাবাসে হাজির হন এক ইহুদি এজেন্ট। ইরাকি বিমানবাহিনীর লড়াকু জেটের পাইলট মুনির রেদফার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি। ডলারের বিনিময়ে তাকে বশ করা যাবে বলে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেন তিনি।
প্যারিসের দূতাবাস থেকে এই খবর মোসাদের সদর দফতরে পৌঁছাতেই হাতে চাঁদ পায় ইসরায়েল। এতটুকু সময় নষ্ট না করে রেদফার ব্যাপারে খোঁজখবর শুরু করে তারা। জানা যায়, খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তিনি। তাছাড়া বিদ্রোহের অভিযোগ তুলে কুর্দ জনজাতির উপর হামলার জন্যও বাগদাদের সরকারের উপর বেজায় খাপ্পা ছিলেন ওই ইরাকি জেট পাইলট। আর তাই দেশ ছাড়ার ফিকির খুঁজছিলেন তিনি।
১৯৬৪ সালে এই রেদফার সঙ্গে যোগাযোগ করতে ‘জর্জ বেকন’ ছদ্মনামে একজন এজেন্টকে বাগদাদে পাঠায় মোসাদ। ইরাকে পৌঁছে নিজেকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন তিনি। সংশ্লিষ্ট জেট পাইলটের সঙ্গে দেখা করতে তাকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। শেষে ফোরাত নদীর তীরে একটি পার্কে তার সঙ্গে দেখা করেন রেদফা। সেখানে একটি বেঞ্চে বসে কথা বলেন দু’জন।
ইহুদি এজেন্টকে ইরাকি জেট পাইলট জানিয়ে দেন, মিগ-২১ ‘চুরি’র পারিশ্রমিক হিসেবে ১০ লাখ ডলার নেবেন তিনি। এই অর্থ তার সুইস ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে পাঠাতে হবে ইসরায়েলকে। তাছাড়া শর্ত হিসেবে পরিবারের ৪৩ সদস্যের নিরাপত্তার আশ্বাস চেয়েছিলেন রেদফা, যা দিতে রাজি হয়ে যায় তেল আবিব। ফলে ধীরে ধীরে গতি পেতে থাকে ‘অপারেশন ডায়মন্ড’।
পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে রেদফার পরিবারের সদস্যদের ইরাক থেকে বের করে আনেন ইহুদি এজেন্টরা। তাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হয়। তাকে অর্থ দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন ইসরায়েলের তৎকালীন সামরিক প্রধান অ্যাইজাক রবিন। সুইস ব্যাংকে ডলার পাঠানোর আগে বাগদাদের জেট পাইলটকে ডেকে পাঠান তিনি। ইহুদিভূমিতে পৌঁছে ‘চুরি’ করা লড়াকু জেট কোথায় অবতরণ করবে, তা দেখে নেন রেদফা।
অভিযানের কিছু দিন আগে স্ত্রী এবং কন্যাকে নিয়ে প্যারিসে যান ওই ইরাকি জেট পাইলট। সেখানেও ইহুদি এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। এরপর তার পরিকল্পনার কথা স্ত্রীকে জানান রেদফা। এতে রেগে গিয়ে সব কিছু ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেন রেদফার স্ত্রী। কোনওমতে তাকে শান্ত করেন ইসরায়েলি গুপ্তচরেরা। দেশে ফিরে স্ত্রীকে ইরান সীমান্তে পাঠিয়ে দেন রেদফা। সেখান থেকে কুর্দ বিদ্রোহীদের সাহায্যে সাবেক পারস্য দেশে ঢোকেন তিনি।
ইরান থেকে নিরাপদে রেদফার স্ত্রীকে ইহুদিভূমিতে নিয়ে আসে মোসাদ। এরপর মিগ-২১ ‘চুরি’ করার ক্ষেত্রে তার সামনে আর কোনও বাধাই ছিল না। ১৯৬৬ সালের ১৬ আগস্ট প্রশিক্ষণের সময় সংশ্লিষ্ট জেটটি নিয়ে চম্পট দেন তিনি। প্রথমে তুরস্কের দিকে উড়ে যান রেদফা। সেখানে মাঝ-আকাশে তেল ভরে জর্ডানের উপর দিয়ে উড়ে ইসরায়েলে বিমান নিয়ে নামেন তিনি। গোটা অপারেশনে সময় লেগেছিল এক ঘণ্টার সামান্য বেশি।
মিগ-২১ নিয়ে রেদফা জর্ডানের আকাশে ঢুকতেই তার জেট চিহ্নিত করে ফেলে সেখানকার বিমানবাহিনী। ওই সময়ে মাথা ঠান্ডা রেখে নিজেকে সিরিয়ার পাইলট বলে পরিচয় দেন তিনি। বলেন, প্রশিক্ষণ মিশন চলাকালীন রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে তার জেট। ফলে সংশ্লিষ্ট মিগ-২১কে তাড়া করার কোনও তাগিদ জর্ডানের বিমানবাহিনী অনুভব করেনি। রেদফাও নির্বিঘ্নে সেটা নিয়ে ইহুদিভূমিতে চলে আসতে পেরেছিলেন।
এরপর ইরাক থেকে চুরি করে আনা মিগ-২১-এর খুঁটিনাটি জানতে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীদের সাহায্য নিয়েছিল ইসরায়েল।
অন্যদিকে এই ঘটনায় মস্কোর সঙ্গে বাগদাদের সম্পর্কে চিড় ধরে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ওই সময় ইহুদি বিমানবাহিনীর বহরে ছিল ফরাসি জেট মিরাজ। ধারে ও ভারে সোভিয়েত যুদ্ধবিমানটির তুলনায় এর শক্তি ছিল অনেকটাই কম।
১৯৬৭ সালের জুনে ছ’দিনের যুদ্ধে আরব দুনিয়ার তিনটি দেশের সম্মিলিত বাহিনীকে পুরোপুরি পর্যুদস্ত করে ইসরায়েল। শুধু তা-ই নয়, মিসরের থেকে সিনাই উপদ্বীপ ও গাজা, সিরিয়ার থেকে গোলান মালভূমি এবং জর্ডানের ওয়েস্ট ব্যাংক কব্জা করে ইহুদিবাহিনী। এই সাফল্যের নেপথ্যে ছিল আকাশযুদ্ধে তেল আবিবের অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা, চার বছর আগে যার পরিকল্পনা করেছিলেন দূরদর্শী ডেভিড বেন-গুরিয়ন এবং মোসাদের গুপ্তচরেরা। সূত্র: দ্য ওয়ার, জিনিউজ, ইউরাশিয়ান টাইমস, সাউথ আফ্রিকান জিউস রিপোর্ট, ট্রেঞ্চআর্ট
বিডি প্রতিদিন/একেএ