কাতারের রাজধানী দোহায় উদ্বোধন হলো বিশ্বের প্রথম এম এফ হুসাইন সংগ্রহালয়। যার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন ভারতীয় আধুনিক শিল্পের বিতর্কিত ও প্রভাবশালী শিল্পী মকবুল ফিদা হুসাইন। তিনি ২০০৬ সালে চিত্রকর্ম নিয়ে বিতর্ক, হুমকি এবং মামলা-মোকদ্দমার মুখে ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
জীবনের শেষ দশক তিনি কাটান দোহায়। সেই সময়েই তৈরি হয় তাঁর সবচেয়ে বৃহৎ ও বহুস্তরীয় শিল্পকর্মগুলোর একটি অধ্যায়। সেই শেষ অধ্যায়কে ঘিরেই গড়ে উঠেছে নতুন সংগ্রহালয়-‘লওহ ও কলাম: এম এফ হুসাইন মিউজিয়াম’।
এডুকেশন সিটিতে কাতার ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই তিন হাজার বর্গমিটারের সংগ্রহালয়টি হুসাইনের নিজের আঁকা এক স্কেচ থেকে নকশা নেওয়া। জীবদ্দশায় তিনি যে সংগ্রহালয় কল্পনা করেছিলেন, বাস্তবে সেটিই প্রথমবার তৈরি হলো।
ভেতরে স্থায়ীভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে তাঁর শেষ দশ বছরের ৩৫টিরও বেশি কাজ। এর মধ্যে আছে শেখা মোজা বিনতে নাসেরের অনুরোধে তৈরি ‘আরব সভ্যতা’ সিরিজ এবং তাঁর শেষ মাল্টিমিডিয়া সৃষ্টি ‘সিরু ফি আল আরধ’।
২০০৬ সালে দেশ ছাড়ার পর ২০১০ সালে তিনি কাতারের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ২০১১ সালে ৯৫ বছর বয়সে লন্ডনে মৃত্যুর আগে তাঁর সবচেয়ে সৃজনশীল সময় কাটে দোহায়। যেখানে তিনি বাধাহীনভাবে আঁকতে পেরেছিলেন। কাতার ফাউন্ডেশনের কমিউনিটি এনগেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক খোলৌদ আল আলি বলেন, “হুসাইন ছিলেন অত্যন্ত কল্পনাশক্তিসম্পন্ন আধুনিক শিল্পী। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর জন্ম হয়েছে এখানে। তাই তাঁর নামে একটি সংগ্রহালয় গড়ে তোলা ছিল স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত।”
শুধু শিল্প নয়, এই সংগ্রহালয়কে রাখা হয়েছে শিক্ষা, গবেষণা এবং জনসম্পৃক্ততার কেন্দ্রবিন্দুতে। এডুকেশন সিটির লক্ষ্য হলো—শিক্ষা, ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং শিল্প—সবকিছুর সমন্বয়ে নাগরিক জীবনে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা। হুসাইনের ছবি, চলচ্চিত্র, নকশা ও গল্প বলার ধরন এই ভাবনার সঙ্গে মিল রেখেই সাজানো হয়েছে সংগ্রহালয়টি। আগামী এক বছরে এখানে অনুষ্ঠিত হবে নানা প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র প্রদর্শন, কর্মশালা, পরিবার–কেন্দ্রিক অনুষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ কর্মসূচি।
সংগ্রহালয়টির নকশা করেছেন ভারতীয় স্থপতি মার্তান্দ খোসলা। শুরুতেই তাঁকে দেওয়া হয় হুসাইনের মূল স্কেচ। স্কেচটিকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে সম্পূর্ণ কাঠামো—বাহিরের নীল মোজাইক–ঘর, ধূসর ব্লকের ধারণা, খোলা ও বন্ধ স্থান—সবই হুসাইনের শিল্প–দর্শনের প্রতীক। নকশাটি একদিকে আধুনিক, অন্যদিকে আরব অঞ্চলের সঙ্গে স্থাপত্যিক সংযোগ বজায় রেখেছে। সংগ্রহালয়টি একটি উঁচু প্ল্যাটফর্মে স্থাপিত—যেন শিল্পের মঞ্চ। মাঝের বৃত্তাকার টাওয়ারটি ভেতরের দৃশ্যপথকে দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছে—যেন দর্শনার্থী হুসাইনের ভ্রমণ, তাঁর ভাবনা আর তাঁর বহুসাংস্কৃতিক জীবনের পথ অনুসরণ করতে পারেন।
এই সংগ্রহালয় শুধু শিল্পীর উত্তরাধিকার প্রদর্শন করে না, বরং তাঁর অস্থির, অনুসন্ধানী যাযাবর চিত্তের এক স্থায়ী আশ্রয়ও তৈরি করেছে। মুম্বাই, লন্ডন, দুবাই থেকে দোহা—অসংখ্য শহরের স্মৃতি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো শিল্পী হুসাইন আজ যেন স্থির হয়ে থামলেন লওহ ও কলামে।
সূত্র: দ্য ন্যাশনাল, আল-জাজিরা
বিডি প্রতিদিন/আশিক