নব্বইয়ের দশক থেকে নানা চড়াই-উতরাই পার করছে ঢাকার চলচ্চিত্র। এ প্রতিকূলতার মধ্যে প্রধান একটি সংকট হলো দক্ষ নতুন শিল্পীদের আগমন নিয়ে। রাজ্জাক, বুলবুল আহমেদ, সোহেল রানা, আলমগীর, ফারুক, ওয়াসিম, জসিম, ইলিয়াস কাঞ্চন প্রমুখ যখন নায়কের চরিত্রে আর মানাচ্ছিলেন না, ওই সময় তাঁদের স্থান পূরণে পর্যায়ক্রমে নতুনদের আগমন সেভাবে ঘটেনি। নায়িকার ক্ষেত্রেও একই কথা। সুচন্দা, শবনম, কবরী, শাবানা, ববিতা, সুচরিতা, অলিভিয়া, অঞ্জু ঘোষ, চম্পা, দিতি প্রমুখের শূন্য আসনও সেভাবে পূরণ হয়নি।
বলিউডে অমিতাভ বচ্চনসহ অন্যরা নায়কের ভূমিকা থেকে বিদায় নিতে নিতে অনিল কাপুর, আমির খান, সালমান খান, শাহরুখ খান, অজয় দেবগন, অক্ষয় কুমার, সাইফ আলী খান প্রমুখ নায়ক নিজ নিজ দক্ষতায় ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন। একই সঙ্গে হেমা- রেখারা নায়িকার আসন থেকে সরে যেতে যেতে শ্রীদেবী, মাধুরী দীক্ষিত, জুহি চাওলা, দিব্যা ভারতী, মনীষা কৈরালা, কাজল, রাণী প্রমুখের আবির্ভাব ঘটে। এসব তারকা বিদায় নিতে নিতে আবার নতুন একঝাঁক অভিনয়শিল্পী এসে মুম্বাইয়ের ফিল্ম দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
কিন্তু ঢাকার চলচ্চিত্রে সেভাবে পুরোনোদের বিশাল শূন্যতা পূরণ হয়নি। আশির দশকে এফডিসি ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন শিল্পী অন্বেষণে নামে। এতে সফলও হয়। মান্না, সোহেল, দিতি, সুব্রত, অমিত হাসান, মিশা এসে পূর্বসূরিদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হন। আরও পরে মৌসুমী, পপি, শাবনাজ, শাবনূর প্রমুখ এসে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
এর মধ্যে রুবেল অ্যাকশন ছবির মারপিটে কিছুটা বৈচিত্র্য এনে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। টিভি তারকা হুমায়ুন ফরীদি বেশ কয়েকটা ছবিতে কৌতুকময় কুটিল চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক টেনেছেন। মান্না বিপুলসংখ্যক ভক্ত গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। বাপ্পারাজ, রিয়াজ, শাকিল, ওমর সানী, অমিত হাসান, ফেরদৌস, আমিন খান প্রমুখরা বেশ দর্শক টেনেছেন, তবে তাঁদের অভিনয়জীবন পূর্বসূরিদের মতো গতিশীল ছিল না। একটা সময় থেমে গেছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন সালমান শাহ। ঢাকার চলচ্চিত্রে সালমানের আগমন ধূমকেতুর মতো। তিনি এলেন, দেখলেন, জয় করলেন, তারপর আকস্মিকভাবে সবাইকে কাঁদিয়ে অকালে বিদায় নিলেন। ১৯৯৩ সালে মুক্তি পেল সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। এতে মৌসুমী-সালমানের জুটি লুফে নিলেন দর্শক। ব্যস, শুরু হয়ে গেল সালমানপর্ব। মাত্র বছর চারেক ঢাকার চলচ্চিত্রে ছিলেন তিনি। এর মধ্যে ২৭টি ছবিতে সদর্পে অভিনয় করেছেন। প্রায় প্রতিটি ছবিই সুপার হিট। ১৯৯৬ সালে এই তারকার আকস্মিক মৃত্যুতে ঢাকার চলচ্চিত্রে আক্ষরিক অর্থেই বড় ধরনের ছন্দপতন ঘটে। এরপর মান্না ও রিয়াজ অনেক দিন দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে গেলেও ২০০৮ সালে মান্নার অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। দেশজুড়ে অগণিত ভক্তকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। একই বছর থেকে রিয়াজের রোমান্টিক ধাঁচের ছবি একঘেয়েমি লাগতে থাকে দর্শকদের। তার ছবি আর চলছিল না। তারপর একচ্ছত্র নায়ক হিসেবে ঢাকার চলচ্চিত্রে আসীন হন শাকিব খান। এখনো তার সফল যাত্রা চলছে। এ ছাড়া আর দক্ষ নায়ক কোথায়? অন্য নায়কদের ছবি দর্শক তেমনভাবে দেখেই না বলে মন্তব্য সিনেমা হল মালিকদের। পাশাপাশি দক্ষ নায়িকাও হাতে গোনা। জয়া আহসান, অপু বিশ্বাস, বুবলী, পরীমণি, নুসরাত ফারিয়া, পূজা চেরী ছাড়া অন্য নায়িকারা সাড়া জাগাতে পারেননি।
চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াৎ বলেন, আমাদের দেশে শিল্পী তৈরির জন্য পর্যাপ্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা নেই। যারা আসছে তারা দেখে দেখেই অভিনয় শিখছে। আগে এই শেখার প্রতি শিল্পীদের আগ্রহ ছিল। এখন তাও নেই। বেশির ভাগ শিল্পী আসে, অল্প পরিশ্রম ও সময়ে অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হতে। ফলে অকালেই ঝড়ে যায় তারা। এ ছাড়া একসময়ে চলচ্চিত্র নির্মাতারাই ছিলেন শিল্পী তৈরির কারিগর। তারা হাতে কলমে শিখিয়ে একজন শিল্পীকে দক্ষ তারকা হিসেবে গড়ে তুলতেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, বর্তমান সময়ে বেশির ভাগ নির্মাতাই হলেন এই শিল্প সম্পর্কে অজ্ঞ ও অশিক্ষিত।
সুতরাং শিক্ষকই যদি অজ্ঞ হন তাহলেই ছাত্ররা দক্ষ হবে কীভাবে। হালে ঢাকাই সিনেমায় দক্ষ নায়ক নায়িকার এ আকালের কারণে ছবিও পর্যাপ্ত পরিমাণে নির্মাণ হচ্ছে না। যা নির্মাণ হচ্ছে তাও অদক্ষ শিল্পীর কারণে আশানুরূপ ব্যবসা সফল হচ্ছে না। এ কারণে লোকসান গুনে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের প্রায় ৯৫ ভাগ সিনেমা হল। মানে সংকটে পড়ে বিপর্যস্ত এখন দেশের সবচেয়ে বড় গণমাধ্যম চলচ্চিত্র শিল্প।