জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত মাদারদহ নদীকে বিল দেখিয়ে দীর্ঘ বছর ধরে মাছ চাষের জন্য ইজারা দিয়ে আসছে জেলা প্রশাসন। নদীটিতে যমুনার পানি প্রবাহমান থাকলেও নদীতে আড়াআড়ি বাঁশ ও জাল বসিয়ে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হয়।
এতে নদীতে মাছ ধরতে পারত না স্থানীয়রা। নদীতে নামলেই দেওয়া হয় মামলা।
জেলা প্রশাসক কার্যালয় ও উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ অক্টোবর জেলার ১৮টি জলমহাল ছয় বছরের জন্য ইজারা দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ওই বিজ্ঞপ্তির তালিকায় মাদারদহ নদীকে মাদারদহ সাবারিয়া বিল হিসেবে উল্লেখ করা হয়। নথিতে নদীর আয়তন দেখানো হয়েছে হরিপুর, বানিয়াবাড়ী, তেঘরিয়া ও পয়লা মৌজায় মোট ১১৮.৮৪ একর। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, প্রতিবছরের ইজারামূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ১৭ হাজার ৮৭৫ টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের হরিপুর গ্রাম থেকে পয়লা পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মাদারদহ নদীকে বহু বছর ধরেই বিল হিসেবে উল্লেখ করে ইজারা দেওয়া হচ্ছে। ১৯৮৬ সালে নদীকে বিল দেখিয়ে ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
ওই সময় নদীটি দুই হাজার ১৫০ টাকায় ইজারা হয়। সর্বশেষ ইজারামূল্য ছিল এক লাখ ৮৫ হাজার টাকা। তবে গত ৩০ অক্টোবর নতুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর এবার কেউ ইজারা নিতে আগ্রহ দেখায়নি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ইসলামপুর উপজেলার চিনডলি ইউনিয়নের দেওয়ানপাড়া এলাকার যমুনা নদী থেকে একটি শাখা নদী বের হয়ে পচাবহলা, সাদিপাটি হয়ে চিনিতোলা গ্রাম পর্যন্ত আলাই নদী নামে পরিচিত। একই নদী চিনিতোলার পর হরিপুর হয়ে পয়লা পর্যন্ত মাদারদহ নামে চলে এসেছে।
এরপর নদীটি রুকনাইপাড়ার পর থেকে কাটাখালী নামে পরিচিত হয়ে বন্দরৌহা, আদ্রা, দাঁতভাঙা ও বেলতৈল হয়ে সরিষাবাড়ী উপজেলার মধ্য দিয়ে জগন্নাথগঞ্জ পুরাতন ঘাটে গিয়ে আবার যমুনায় মিলিত হয়েছে।
এদিকে জামালপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সুমী আক্তারের স্বাক্ষরিত নদ-নদীর তালিকায়ও মাদারদহ নদীর নাম রয়েছে। সেখানে উৎসমুখ দেখানো হয়েছে তেঘরিয়া এবং পতিতমুখ পয়লা এলাকা। নদীর দৈর্ঘ্য উল্লেখ করা হয়েছে দুই কিলোমিটার।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নদীর কোথাও পানি কম, কোথাও বেশি, তবে এখনো পানির প্রবাহ রয়েছে। অনেক জায়গায় বালুচর জেগে উঠেছে। হরিপুর থেকে এঁকেবেঁকে নদীটি পয়লার দিকে চলে গেছে।
হরিপুর এলাকার বৃদ্ধ আব্দুল আজিজ বলেন, ‘মাদারদহ বহু পুরনো একটি নদী। আমাদের জন্মের আগেও ছিল। এর উৎপত্তি যমুনা, শেষও যমুনায়। মাঝপথে জায়গাভেদে এর নাম পরিবর্তন হয়েছে। কয়েক দশক ধরে কিভাবে নদী ইজারা হচ্ছে, তা আমাদের জানা নেই।’
পয়লা এলাকার কৃষক শাজাহান বলেন, ‘এটা নদী-বাপ-দাদার আমল থেকেই নদী। নদীকে বিল দেখিয়ে ইজারা দেওয়া হচ্ছে। কাউকে নদীতে নামতে দেয় না।’
স্থানীয় সাইফুল বলেন, ‘নদীতে ইজারাদাররা কাউকে নামতে দেয় না। নামলেই মামলা দেয়। এখনো নদীতে পানি আছে। মাঝখানে জাল ও বাঁশের বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করে।’
জামালপুর নদী রক্ষা কমিটির সদস্য ও পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, ‘নদীকে মাছ চাষের জন্য ইজারা দেওয়ার কোনো ক্ষমতা বা আইন নেই। হয়তো কোনো সময় কোনো প্রভাবশালীর চাপে ইজারা শুরু হয়েছিল, পরে তা চালু আছে। কিভাবে ইজারা হচ্ছে এটা জানা নেই।’
জামালপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান বলেন, ‘মাদারদহ নদী ইজারা হয় কি না সে সম্পর্কে আমার জানা নেই।’
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সুমী আক্তার বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে যেভাবে ইজারা হচ্ছে, সেটাই চলমান। মাদারদহ সায়রাতভুক্ত। মাদারদহ এইটা নদী নাকি বিল পানি উন্নয়ন বোর্ড বলতে পারবে। যদি নদী হয় তাহলে সায়রাতভুক্ত বাতিল হবে।’