তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টের উচ্চতা বঙ্গোপসাগর থেকে ৫৪ মিটারের কিছু বেশি। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়টিকে শুকনো মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এখন নভেম্বরের শেষের দিকে নদীতে পানি প্রায় শূন্য পর্যায়ে নেমে এসেছে। ক্রমাগত পলি পড়ার কারণে নদীর নিম্নাংশ ভরাট হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় তৈরি হয়েছে ধু-ধু বালুচর। দীর্ঘদিন ধরে ড্রেজিং না হওয়ায় প্রতিবছরই বাড়ছে পলির স্তর। ব্যারেজের মধ্য দিয়ে এসব পলি প্রবাহিত হয়ে ডালিয়া থেকে রংপুরের কাউনিয়া পর্যন্ত প্রায় ৬৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে জেগে উঠেছে বিশাল চর।
শুকনো মৌসুমে তিস্তায় চারদিকে দেখা যায় বালুচর ছাড়া কিছুই নেই। নদীর আশপাশের এলাকায় পানির স্তর অনেক নেমে গেছে। ফলে সেচ মৌসুমে পানির অভাবে দেশের বৃহত্তম তিস্তা সেচ প্রকল্প পুরো কমান্ড এলাকায় পানি সরবরাহ করতে পারে না। ভারতের গজলডোবায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে তিস্তা সেচ প্রকল্পে প্রতিবছরই পানি ঘাটতি দেখা দেয়। আবার বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ায় ব্যারেজ ও আশপাশের অঞ্চল ঝুঁকির মুখে পড়ে। কোটি কোটি টন পলি নদী ভরাট করলেও তা অপসারণে কোনো উদ্যোগ না থাকায় শুকনো মৌসুমে তিস্তাকে চেনাই যায় না।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার সকালে ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ ছিল প্রায় ৬ হাজার কিউসেক। প্রতিদিনই পানি কমছে। জানুয়ারি মাসে শুরু হবে সেচ মৌসুম। এ সময় নদীতে পানির প্রয়োজন থাকে কমপক্ষে তিন থেকে চার হাজার কিউসেক। কিন্তু তখন এত পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। ফলে সেচ কমান্ড এলাকায় পুরোপুরি সেচ দেওয়া সম্ভব হয় না। অথচ বর্ষায় প্রতিদিন দুই লাখ কিউসেকের বেশি পানি ছেড়ে নদীর দু’কূল ভাসিয়ে দেয় ভারত। পরিস্থিতি যুগের পর যুগ একই থাকলেও কার্যকর কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তিস্তা সেচ প্রকল্প সম্পর্কে জানা গেছে, ডালিয়ায় তিস্তার পানি ব্যবহার করে সেচ সুবিধা দেওয়ার প্রথম পরিকল্পনা নেওয়া হয় ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর দুই দেশ আলাদাভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। প্রথম সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা হয় ১৯৬০ সালে এবং দ্বিতীয় সমীক্ষা প্রতিবেদন সম্পন্ন হয় ১৯৬৯–৭০ সালে। পাকিস্তান আমলে প্রকল্পটি পরিকল্পনা পর্যায়ে থাকলেও স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রকল্পের মাধ্যমে ১ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমিকে সেচের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত থাকলেও পানির প্রবাহ ঠিক না থাকায় প্রত্যেক মৌসুমেই দেখা দেয় তীব্র পানিসঙ্কট।
তিস্তা ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার একটি উপনদী। উত্তর সিকিমের পার্বত্য অঞ্চল থেকে লাচেন ও লাংচু নামে দুটি স্রোতধারা তিস্তাকে জন্ম দিয়েছে। সিকিমের চুংথাংয়ে এই দুই স্রোত মিলিত হয়। এরপর ভাটিতে তিস্তা আস্তে আস্তে প্রশস্ত হতে থাকে। সিংতামে এর প্রস্থ ৪৩ মিটার। চুংথাং ও সিংতামের বহু পর্বতধারা তিস্তাকে সমৃদ্ধ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাংনিচু, ডিকচু, তালাংচু ও চাকুংচু। বড় উপনদী রাংনিচু সিতামে গিয়ে তিস্তায় মিলেছে এবং বাকি তিনটি গ্যাংটকের কাছে মিলিত হয়েছে।
পর্বত থেকে উৎপন্ন হয়ে তিস্তা ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার সিবকের কাছে সমতলে নামে এবং সেখান থেকে লিশ, সিশ, চেল ও নেংড়া—এই পর্বতস্রোতধারাগুলোর সঙ্গে মিলিত হয়ে আরও স্ফীত হয়ে ওঠে। দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার অতিক্রম করে নদীটি জলপাইগুড়ি জেলার রায়গঞ্জ থানার পূর্বপ্রান্ত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সদর ও ময়নাগুড়ি এলাকা পার হয়। প্রায় ৫৬ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে তিস্তা নীলফামারীর ডিমলার ছাতনাই গ্রামের উত্তর দিক দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এরপর প্রায় ১১৬ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে যমুনার সঙ্গে মিশে যায়।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, নভেম্বর থেকে শুকনো মৌসুম শুরু হয়। এসময় নদীতে পানি স্বাভাবিকভাবেই কম থাকে।
বিডি-প্রতিদিন/মাইনুল