সাত বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা নিলেও তা কোনো কাজে আসেনি। আন্তর্জাতিকভাবেও মিয়ানমারের প্রতি প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। এমনকি এই ইস্যুতে প্রতিবেশী দেশ ভারত-চীনকেও পাশে পায়নি বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, খোদ জাতিসংঘ মহাসচিব এসে কক্সবাজারে ক্যাম্প পরিদর্শনের পর রোহিঙ্গা নাগরিকদের মিয়ানমারে ফেরানোর ঘোষণা দেন গত মার্চে। এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় আট মাস। কিন্তু এ কার্যক্রমে কোনো অগ্রগতি হয়নি বললেই চলে। এরই মধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি বিশেষ অধিবেশনও করা হয়। সেখানে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর জোর দাবি তোলা হয়। সে সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা এ কাজে বাংলাদেশকে সহায়তার আশ্বাসও দেয়। এর আগে ঢাকায়ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘে বিশেষ অধিবেশনের মাধ্যমে রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে সাত দফা প্রস্তাব উত্থাপন করা বাংলাদেশের পক্ষে। কিন্তু সেসব প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে মিয়ানমার। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে-পরবর্তী সরকার এসে এই ইস্যুতে জোরালো পদক্ষেপ নেবে। বিশেষ করে কূটনৈতিক সমর্থনের মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে নির্বাচিত সরকার জোরালো প্রস্তাব রাখবে। এতে রোহিঙ্গা সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বেরিয়ে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, মিয়ানমারের প্রতি চাপ সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ে এক ধরনের ক্যাম্পেইনও পরিচালনা করা হয়েছে। মিয়ানমার সরকার তৃতীয় কোনো স্থান বা অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাসন করানোর পক্ষে প্রস্তাব দিলেও পরবর্তীতে তা নাকচ করে দেয়। একইভাবে জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলাদেশের উত্থাপিত সাত দফা প্রস্তাবও সম্প্রতি নাকচ করে দিয়েছে।
মিয়ানমার সরকার মনে করে রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর সেখানে আর বসবাসের পরিবেশ নেই। তবে রোহিঙ্গা নাগরিকদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনে যাবে জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধিদল। সে পরিকল্পনাও ভেস্তে গেছে। ফলে এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার কোনো পরিকল্পনাই কাজে আসেনি।
এদিকে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত ও চীনের অবস্থান এবং রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সংকট সমাধানে কতটা এগিয়ে আসছে সেটা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা। অবশ্য বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেছেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় গতি আনতে আমরা নানারকম উদ্যোগ নিয়েছি, প্রতিবেশী দেশগুলোকেও আমরা সক্রিয়ভাবে সঙ্গে থাকার কথা বলে আসছি। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে জাতিসংঘের পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে চাপ তৈরি করতে ভারত ও চীনের অবস্থানও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এদিকে খোদ জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে শরণার্থীদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের ঘোষণা দেওয়ার আট মাস পরও এ আলোচনার কোনো অগ্রগতি হয়নি। উল্টো এই সময়ে আরও বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা নাগরিককে বলপূর্বক বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসনবিষয়ক কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুতই শুরু হবে প্রত্যাশা করা হলেও এতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারই সব সময় এতে সময় ক্ষেপণ করে আসছে। আমরা আন্তর্জাতিকভাবেও জনমত জরিপের চেষ্টা করছি। প্রত্যাবাসন বিষয়ে আমরা আমাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তনও দেখছি। যত দিন না রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে, তত দিন আমরা এ সংকটের কোনো টেকসই সমাধান দেখছি না এবং সেই সমাধানটা মিয়ানমারেই নিহিত আছে। এখানে জাতিসংঘের আরও জোরালো ভূমিকা থাকা দরকার।