ভিন্নমত—এটি মানবজীবনের এক অনিবার্য ও মৌলিক সত্য; যত পুরনো কথা বলার সূচনা, ততটাই প্রাচীন, আর যতটা স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নেওয়া, ততটাই স্বতঃস্ফূর্ত। এটি শুধু মতের অমিল নয়; বরং মানব-সচেতনতার এমন এক স্বাভাবিক দিক, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রত্যেক মন তার নিজস্ব পরিবেশ, অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি দিয়ে সত্যকে ভিন্ন কোণ থেকে দেখে। কৃতিত্ব এ নয় যে সবাই একইভাবে ভাবলাম; কৃতিত্ব এই যে ভিন্নমতের মধ্যেও আমরা একসঙ্গে থাকার মানসিক ও নৈতিক শক্তি ধরে রাখলাম। বিপদ ভিন্নমত থাকার মধ্যে নয়; বরং সেই আচরণে, যা আমরা ভিন্নমত দেখলে গ্রহণ করি।
আমরা কি অন্যের চিন্তাকে সম্মানের সঙ্গে স্বীকার করি, নাকি নিজের আধিপত্যকে হুমকির মুখে মনে করে বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাই?
মানুষের সবচেয়ে গুরুতর ভুল হলো, নিজের পছন্দকে শক্তি বা সত্য ভেবে বসা। ‘এটা আমার মত’ থেকে ‘এটা তোমাকেও মানতে হবে’, এই সামান্য দূরত্বই মানুষকে মুক্ত আলাপের প্রশস্ত প্রান্তর থেকে টেনে নিয়ে যায় একটি সংকীর্ণ, ভয়ে ভরা বৃত্তে। সেখানে অপরজন আর ভাবনার সঙ্গী নয়; বরং বাধা কিংবা সংশোধনের বিষয় হয়ে যায়। এতে সম্পর্ক শক্ত, কঠোর এবং অনমনীয় হয়ে ওঠে। যা কখনো ছিল সংলাপ, তা রূপ নেয় সংঘাতে।
‘আমরা ভিন্নমতে একমত’ এ কথা কেবল একটি বাক্য নয়; এটি এক দর্শন, এক নৈতিক ঘোষণা। এর মানে, ভিন্নমত পরাজয় নয়, ব্যথাও নয়; বরং এক জীবন্ত অবস্থা, যা মর্যাদা, আত্মবিশ্বাস ও পরিণত চিন্তার সঙ্গে বয়ে নেওয়া যায়। এর পেছনে আছে এই সত্য; পৃথিবী এত বিস্তৃত, আর সত্য এত বহুস্তরীয় যে একটি দৃষ্টিকোণ কখনো তাকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারে না।
সত্য কোনো একক পাথর নয়; এটি এক দিগন্ত, যেখানে সবাই আলাদা পথে চলতে চলতে, আলাদা অভিজ্ঞতা নিয়ে পৌঁছায়।
কিন্তু যখন ভিন্নমতকে বিদ্রোহ বা হুমকি হিসেবে দেখা হয়, তখন নৈতিক ও বৌদ্ধিক ভূমি বদলে যায়। আলাপচারি রূপ নেয় চাপের, কৌতূহল রূপান্তরিত হয় সন্দেহে, যা ছিল মিলিত কণ্ঠের উজ্জ্বল আবহ, তা সঙ্কুচিত হয় ভয়ের সরু বৃত্তে। নিজের মতকে শক্তিতে পরিণত করে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবৃত্তি বাহ্যত ক্ষমতার মতো মনে হয়; কিন্তু বাস্তবে এটি ভেতরের দুর্বলতা ও অনাস্থার প্রকাশ। ভিন্নমতের নিছক অস্তিত্বই তখন হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, আর সে অস্থিরতার একমাত্র সমাধান হয়ে থাকে অন্যের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেওয়া।
এই কারণেই একরূপতার উন্মাদনা কখনো আবেগিক, কখনো ভাষাগত, কখনো প্রাতিষ্ঠানিক সহিংসতায় পরিণত হয়। কারো স্বাধীনভাবে ভাবার অধিকার কেড়ে নেওয়া মানে তাকে তার মৌলিক মানব-সম্মান থেকে বঞ্চিত করা। সে দেহে থাকে ঠিকই; কিন্তু তার কণ্ঠ সমাজের আকাশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সে আর পূর্ণ মানুষ থাকে না; বরং এক ছায়া হয়ে পড়ে, যতক্ষণ না সে নিঃশব্দ।
এ প্রবণতা শুধু রাজনীতি বা সমাজে নয়; ঘরোয়া সম্পর্কেও ধীরে ধীরে ভিত খেয়ে ফেলে। একজন মানুষ ক্রমে নতি স্বীকার করতে করতে একসময় নিজের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি হয়ে যায়; আর অন্যজন কল্পিত ক্ষমতার নেশায় মাতোয়ারা থাকে। যে পরিসর একসময় ছিল প্রশস্ত, তা অপ্রকাশিত কথা ও চাপা সত্যের ভিড়ে সংকুচিত হয়ে আসে। সম্পর্ক সাধারণত কোলাহলে ভাঙে না; ভাঙে নিরব অবক্ষয়ে, নিঃশব্দ ক্ষয়ে।
সমাজের স্তরে এর প্রভাব আরো গভীর। যখন ভিন্নমতকে সামাজিক জীবন থেকে মুছে ফেলা হয়, তখন সমাজের ভাবনা, প্রশ্ন করার ক্ষমতা এবং উন্নতির উৎস বন্ধ হয়ে যায়। ভিন্নমত ছাড়া চিন্তা ভোঁতা ও স্থবির হয়ে পড়ে; সমালোচনা ছাড়া ভুল ক্রমে বেড়ে ওঠে। একরূপতার জোরে টিকে থাকা সমাজগুলো বাহ্যত শক্ত দেখায়, কিন্তু ভেতরে হয়ে ওঠে ভঙ্গুর, নরম এবং বিবর্তনের জন্য অযোগ্য। ইতিহাস এমন সমাজে পরিপূর্ণ, যাদের দৃঢ়তার মুখোশ ভেঙে পড়েছিল, নিজেদের একরঙা অস্তিত্বের নিচে চাপে।
ভিন্নমত থেকে পালানো চিকিৎসা নয়; চিকিৎসা হলো এমন এক সভ্যতা, যা ভিন্নমতের সঙ্গে বাঁচতে পারে। এর জন্য লাগে মনের ও হৃদয়ের উদারতা; সেই ক্ষমতা, যা অপরের কণ্ঠকে জায়গা দেয়, এমনকি যখন তা আমাদের স্বস্তি ও সুবিধাকে চ্যালেঞ্জ করে। দরকার বৌদ্ধিক বিনয়, যে বিনয় স্বীকার করে—সত্যের সব দিক কারো একার দখলে নেই। এই বিনয় মানুষকে সংকুচিত করে না; বরং মানুষ ও পৃথিবী উভয়কেই বিস্তৃত করে। আর আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্যের পূর্ণ উপলব্ধির জন্য আমরা সবাই একে অপরের প্রয়োজন।
ভিন্নমতের সঙ্গে ভালোভাবে বাঁচতে শেখা মানে হলো, মনের ভেতর উদারতার বিস্তার ঘটানো; এমন প্রস্তুতি রাখা যে ‘তোমার মতামত আমার মতের মতো না হলেও, তাতে আমি ছোট হয়ে যাই না।’ এটি নিজের মতের প্রতি অঙ্গীকার, তবে সেই জোরজবরদস্তি ছাড়া যা অন্যদের ওপর তা চাপিয়ে দিতে চায়। এটি সেই যৌথ পরিসরের প্রতি সম্মান, যে পরিসর সূক্ষ্ম, প্রয়োজনীয় এবং মানবজীবনের জন্য অপরিহার্য।
ভিন্নমতকে সামলানোর ও গ্রহণ করার শিল্পই আসলে আমাদের মানবিকতার মানদণ্ড। অন্যকে ভিন্ন হওয়ার সুযোগ দেওয়া কেবল তার মর্যাদা স্বীকার করাই নয়; এটি আমাদের চিন্তার পরিণতি ও সামাজিক সচেতনতারও প্রমাণ। কারণ, অন্যের কণ্ঠকে স্তব্ধ করা শুধু পৃথিবীকেই সংকীর্ণ করে না, এটা আমাদের নিজেদেরও সঙ্কুচিত করে।
ভিন্নমতে একমত হওয়া কোনো দুর্বলতা নয়; বরং এই বহুরূপী, সদা-পরিবর্তনশীল, ক্রমবর্ধমান মানবজীবনের স্বীকৃতি, যা আমরা সবাই মিলে নির্মাণ করি।
লেখক : প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার, ক্যামব্রিজ ইসলামিক কলেজের ডিন
বিডি প্রতিদিন/মুসা