খেই হারাচ্ছে ভারতীয় রুপি। কোনো মতেই দিল্লি এই সংকটের সমাধান করতে পারছে না। আসলে নরেন্দ্র মোদির দেশের মুদ্রার এই করুণ পরিণতির কারণ কি? বড় ধাক্কা খাওয়ার পথে কি ভারতে অর্থনীতি?
ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর বলছে, দেশটির মুদ্রা খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে বুধবার (৩ ডিসেম্বর)। গত কয়েক দিনের ধারাবাহিক পতনের জেরে এই প্রথমবার ডলারের সাপেক্ষে ৯০ রুপির গণ্ডি পার করে ফেলেছে। রুপি’র এই পতনের প্রভাব কেবল ফরেক্স এক্সচেঞ্জেই সীমাবদ্ধ নয়। সাধারণ মানুষের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে রুপির অবমূল্যায়ন। কীভাবে এই প্রভাব পড়বে, কোন কোন ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে উঠছে সেই প্রশ্ন।
রুপির দামে পতনের পিছনে মূলত তিনটি কারণ তুলে ধরেছেন ভারতের বাজার বিশেষজ্ঞরা। প্রথম কারণ হিসেবে উঠে এসেছে, আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা। এর জেরে ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ ট্যারিফের খড়গ নেমেছে। যা দুই দেশের ব্যবসায় ধাক্কা দিয়েছে।
দেশটির বাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগ সরে যাওয়ার প্রবণতাও এ বছরের শুরু থেকেই বজায় রয়েছে। ধারাবাহিক জিডিপি বৃদ্ধি সত্ত্বেও এই প্রবণতায় ভাটা পড়েনি। যা রুপির উপর চাপ বাড়িয়েছে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার পলিসিগত পরিবর্তনকেও রুপির পতনের জন্য দায়ী করেছেন বিশ্লেষকরা। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার ভারতের এক্সচেঞ্জ রেটকে ‘স্টেবিলাইজড’ থেকে ‘ক্রল লাইক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
ডলারের সাপেক্ষে রুপির দামে পতন এই প্রথম নয়। অতীতেও বিভিন্ন সময়ে রুপির দামে উল্লেখযোগ্য পতন হয়েছে। যেমন ২০২২ সালে, ডলার শক্তিশালী হওয়ার জেরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুদ্রার পতন হয়েছিল। কিন্তু এ বারের পরিস্থিতি তা নয়। এখন ডলার ইনডেক্স স্থিতিশীল রয়েছে। তবুও রুপির দাম হুড়মুড়িয়ে নামছে।
আরও এক লক্ষ্যণীয় বিষয় রুপির দামে পতন রুখতে মাঠে নামেনি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রুপিকে ‘গার্ডিং’-এর থেকে ‘গাইডিং’-এর নীতি নিয়েছে আরবিআই। ভারতীয় মুদ্রার লং টার্ম রেজিলেন্সের জন্যই শীর্ষ ব্যাঙ্ক এই পথে হাঁটছে। যদিও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে ৬৯ হাজার কোটি ডলার গচ্ছিত রয়েছে।
রুপির পতনের জেরে ব্যাপক প্রভাব পড়বে স্টক মার্কেট ও ফরেক্স এক্সচেঞ্জে। কিন্তু এর প্রভাব কেবল এই স্তরেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। স্টক মার্কেটের গণ্ডি ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবনেও প্রভাব ফেলবে রুপির পতন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে। দৈনন্দিন জীবনে ভারতীয়দের ব্যবহৃত অনেক দ্রব্যই আমদানি করা হয় বিদেশ থেকে। রুপির পতনের জেরে ওই সমস্ত জিনিস আমদানি করতে খরচ হবে বেশি। যার জেরে ভারতের বাজারে দামবৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকবে।
ভারতে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৯০ শতাংশই আমদানি করা হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। ভোজ্য তেলের প্রায় ৬০ শতাংশ আমদানি করা হয়। দুর্বল রুপি এই সব পণ্যের দামবৃদ্ধির কারণ হতে পারে। যা নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষদের চিন্তা বাড়াতে পারে। এ ছাড়াও আমদানি করা ল্যাপটপ, ফ্রিজ, স্মার্টফোনের দামও বাড়তে পারে।
রুপির দুর্বলতা বিদেশে পড়তে যাওয়ার খরচ বাড়িয়ে দেবে। বিদেশে কোনও একটি কোর্সের খরচ ৫০ হাজার ডলার। ১ ডলার যখন ৮০ টাকা ছিল তখন খরচ হতো ৪০ লাখ রুপি। এখন তা বেড়ে হবে ৪৫ লক্ষ রুপি। এমনকি ডলারের সাপেক্ষে নেওয়া এডুকেশন লোন আরও ব্যয়বহুল হবে। বিদেশে থাকা এডুকেশন লোনের ইএমআই বাড়বে। এর পাশাপাশি বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার খরচও অনেকটা বেড়ে যাবে।
ছোট ব্যবসায়ীদের উপরেও এর প্রভাব পড়বে। যে সমস্ত ব্যবসায় বিদেশ থেকে বিভিন্ন কাঁচামাল আনা হয়, সেই সব ব্যবসার খরচ বাড়তে পারে। এর জেরে লাভের পরিমাণেও ধাক্কা খেতে পারে। ছোট ব্যবসায়ীদের উপরে এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।
তবে রুপির দামে পতন থেকে এক্সপোর্টারদের একাংশের লাভ হতে পারে। কিন্তু সেই লাভের পিছনে জটিল অঙ্কও জড়িয়ে রয়েছে। ভারতের আইটি ফার্মগুলি ডলারে বিল করে এবং রুপিতে পেমেন্ট করে। এই পতনের তারা উপকৃত হবে। ফার্মা এক্সপোর্টাররাও এর জেরে লাভবান হতে পারেন। তবে তাদের বিদেশ থেকে কাঁচামাল কেনার খরচও বাড়বে। এর পাশাপাশি বিদেশ থেকে যাঁরা রুপি পাঠান সেই ভ্যালু বেড়ে যাবে। ধরুন বিদেশে কর্মরত কোনও ব্যক্তি পরিবারের জন্য প্রতি মাসে ৫০০ ডলার করে পাঠান। রুপির দামে পতনের জেরে তার পরিবার আগের তুলনায় বেশি রুপি পাবেন।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল