যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ভেনেজুয়েলার একটি গোষ্ঠীকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই সংগঠনটির নাম কার্টেল দে লস সোলেস। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, সংগঠনটি ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এবং তাঁর সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।
কোনো সংস্থাকে সন্ত্রাসী তকমা দেওয়া হলে মার্কিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সামরিক বাহিনী তাদের নিশানা করতে পারে। সেই সাথে গোষ্ঠীগুলোকে ভেঙে দেওয়ার জন্য ব্যাপক ক্ষমতাও পায়।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মাদুরো সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে ওয়াশিংটন। কারণ, তারা গত বছরের নির্বাচনকে কারচুপিপূর্ণ আখ্যা দিয়ে মাদুরোর সরকারকে অবৈধ বলছে। এই নতুন তকমা চাপ বাড়ানোর আরেকটি কৌশল।
তবে কার্টেল দে লস সোলেসের অস্তিত্ব আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভেনেজুয়েলার সরকার দৃঢ়ভাবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে এক নতুন এবং আজগুবি মিথ্যা আখ্যা দিয়ে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
ভেনেজুয়েলার স্বরাষ্ট্র ও বিচারমন্ত্রী দিওসদাদো ক্যাবেলো, এই কার্টেলের উচ্চপদস্থ সদস্য বলে অভিযুক্ত, তিনিও একে আমেরিকার দীর্ঘকাল উদ্ভাবিত ঠাহা মিথ্যা বলে অভিহিত করে আসছেন। তিনি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা যাদের অপছন্দ করেন, তাদের নিশানা করতেই এই অজুহাত ব্যবহার করা হয়।
এমনকি ভেনেজুয়েলার প্রতিবেশী কলম্বিয়ার বামপন্থী প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রোও এই কার্টেলের অস্তিত্ব অস্বীকার করে এটিকে অতি-ডানপন্থীদের একটি কাল্পনিক অজুহাত বলছেন। যে তকমা আমেরিকার কথা না শোনা সরকারগুলোকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।
তবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর তাদের অবস্থানে অনড়। তারা বলছে, কার্টেল দে লস সোলেস শুধু অস্তিত্বশীলই নয় বরল এটি ভেনেজুয়েলার সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, আইনসভা এবং বিচার বিভাগকে দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে।
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মনে করেন, সত্য হয়তো এই দুই দাবির মাঝামাঝি কোথাও রয়েছে।
কার্টেল দে লস সোলেস শব্দটি প্রথম ব্যবহার শুরু হয় ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে। ভেনেজুয়েলার ন্যাশনাল গার্ডের কাউন্টার-নারকোটিকস অপারেশনের দায়িত্বে থাকা এক জেনারেলের বিরুদ্ধে মাদক পাচারের অভিযোগ ওঠার পর ভেনেজুয়েলার গণমাধ্যম এই নামটি দেয়। সামরিক বাহিনীর জেনারেলরা তাদের কাঁধের ব্যাজে পদমর্যাদা বোঝাতে যে সূর্য-আকৃতির প্রতীক পরেন, সেই প্রতীক থেকেই এই নামকরণ।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ মাইক লাসাউসার মতে, এই নামটি শীঘ্রই মাদক পাচারের সঙ্গে যুক্ত সকল ভেনেজুয়েলান কর্মকর্তার জন্য ব্যবহার হতে শুরু করে, তারা একই সংগঠনের অংশ না হলেও।
মেক্সিকোর ইউএনএএম বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ রাউল বেনিতেজ-মানাউ বলেন, এই গোষ্ঠীর কার্যক্রম শুরু হয় কলম্বিয়ায় মাদক পাচার বিরোধী অভিযানের প্রতিক্রিয়ায়। কলম্বিয়ার শক্তিশালী মেডেলিন কার্টেল ভেঙে যাওয়ায় মাদক পরিবহনের বিকল্প পথ হিসেবে কার্টেল দে লস সোলেস কাজ শুরু করে। প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের শাসনামলের প্রথম বছরগুলিতে এই কার্টেল আরও শক্তিশালী হয়।
শ্যাভেজ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বন্ধ করে দিলে নজরদারি না থাকায় কিছু ভেনেজুয়েলান সেনা কর্মকর্তা অপরাধীদের সঙ্গে ব্যবসায়িক কাজ শুরু করার স্বাধীনতা পান। শ্যাভেজের সঙ্গে কলম্বিয়ার বামপন্থী ফার্ক গেরিলাদের সুসম্পর্ক থাকায় মাদক পাচারের রুট ভেনেজুয়েলার দিকে সরে যায়।
লাসাউসা জানান, কার্টেল দে লস সোলেস অন্য মাদক নেটওয়ার্কের মতো কোনো আনুষ্ঠানিক কাঠামো নেই। এটি কোনো সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠী নয় বরং ব্যাপক দুর্নীতির একটি ব্যবস্থা। মাদুরোর শাসনামলে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের ফলে এটি আরও উসকে উঠেছে। লাসাউসা বলেন, মাদুরো সরকার নিরাপত্তা বাহিনীকে পর্যাপ্ত বেতন দিতে পারে না এবং তাদের আনুগত্য ধরে রাখতে মাদক পাচারকারীদের কাছ থেকে ঘুষ নিতে দেয়।
তবে মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন, কার্টেল দে লস সোলেসের জাল মাদুরো সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। ২০২০ সালে মার্কিন বিচার বিভাগ মাদুরো এবং আরও ১৪ জনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র কলম্বিয়ান গোষ্ঠীর সাথে ষড়যন্ত্র করে যুক্তরাষ্ট্রে কোকেন পাঠানোর অভিযোগ আনে। অভিযুক্তদের মধ্যে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাডরিনো এবং ভেনেজুয়েলার সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান মাইকেল মোরেনোও ছিলেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, ১৯৯৯ সাল থেকে কার্টেল দে লস সোলেস প্রেসিডেন্ট মাদুরো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিওসদাদো ক্যাবেলো, সাবেক সামরিক গোয়েন্দা প্রধান হুগো কারভাজাল এবং সাবেক জেনারেল ক্লিভার আলকালা কর্তৃক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। এই তথ্যের পেছনে সাবেক উচ্চপদস্থ ভেনেজুয়েলান সামরিক কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য রয়েছে বলে তারা দাবি করে।
এ বছর সাবেক ভেনেজুয়েলান স্পাইমাস্টার কারভাজাল মার্কিন আদালতে মাদক পাচার ও নারকো-সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এবং কার্টেল দে লস সোলেসের অন্যান্য কর্মকর্তারা কোকেনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে নিউইয়র্ক এবং অন্যান্য মার্কিন শহরকে বিষে ভাসিয়েছেন।
নিকোলাস মাদুরো এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিওসদাদো ক্যাবেলো ভেনেজুয়েলায় অবস্থান করছেন। তবে সম্প্রতি তাদের সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার জন্য পুরস্কারের অর্থ যথাক্রমে ৫০ মিলিয়ন ডলার এবং ২৫ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
মাদুরো সরকার এই মাদক পাচারের অভিযোগকে দীর্ঘদিন ধরে অস্বীকার করে আসছে। এটিকে মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার মার্কিন প্রচেষ্টা বলে আখ্যা দিয়েছে।
সূত্র: বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল