‘ওরা ১১ জন’ চলচ্চিত্রের প্রযোজক মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা বলেন, ওরা ১১ জন আমাকে সব দিয়েছিল। বিশেষ করে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা। কিছু অভিমানও দিয়েছে। দিয়েছে কষ্ট। অভিমান এবং কষ্টগুলো নিজের থাক। রাষ্ট্র এতদিন বোঝেনি। বোঝাতেও চাই না। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিই। যুদ্ধ শেষ করে আমি ও আমার বন্ধুরা চিন্তায় পড়ে গেলাম এবার কী করব? এর মধ্যেই মাথায় এলো চলচ্চিত্রের কথা। সবাই ভাবলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়েই তৈরি করা হবে চলচ্চিত্র। সেই ভাবনা থেকেই চলচ্চিত্রে নাম লেখালাম। প্রযোজক হিসেবে আমি আত্মপ্রকাশ করে চাষী নজরুল ইসলামকে দিয়ে নির্মাণ করালাম, ‘ওরা ১১ জন’। এটি স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র। একে শুধু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র বলা যাবে না। কারণ, এ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি জীবনের নানা বাঁক, উত্থান-পতন, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহের নানা কথা উঠে এসেছে। তাই আমি একে অন্য দশটির মতো ছবি বলতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের পর দৈনিক ইত্তেফাকের ‘রূপবাণী’তে সিনেমাবিষয়ক লেখা লিখতাম। নিজে ‘নূপুর’ নামে মাসিক পত্রিকা বের করতাম। অনেকে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে থাকেন। সেখানে মূল উদ্দেশ্য থাকে মুহূর্তগুলোকে নিজের ক্যামেরায় ধারণ করা। ঠিক তেমনি আমিও মূলত মুক্তিযুদ্ধের মুহূর্তগুলোকে ধারণ করে রাখতে সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে কিছু ঘটনা ঘটেছিল। সে ঘটনাগুলোকে মালার মতো করে গাঁথতে চেয়েছিলাম। সে সময় সম্ভবত ‘চিত্রালী’তে মাসুম চলচ্চিত্রের প্রযোজক ইয়াহুদী নামে একজন লিখতেন। এমনভাবে লিখতেন চলচ্চিত্রের বিভিন্ন মানুষকে ধরে যে মনে হতো তিনি ঘটনাস্থলে আছেন। অথচ যাকে নিয়ে লিখছেন সে বুঝত, কিন্তু তার নাম দেওয়া থাকত না। পরে জানলাম যে লিখছেন তিনি বিখ্যাত চিত্রনাট্যকার আল মাসুদ। চাষী নজরুল ইসলামের মাধ্যমে তার কাছে গেলাম। আমি আল মাসুদকে ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমার গল্পগুলো শোনালাম। তিনিই পরে আমার ছোট ছোট ঘটনার ফুলগুলোকে একসঙ্গে মালায় গেঁথে দিয়েছেন। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপিত হয়েছিল ১১ দফা ছাত্র আন্দোলন থেকে, যা পরবর্তীকালে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। তা ছাড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ১১ জন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। এই চিন্তা থেকে সবার সম্মতিক্রমে ছবির নাম নির্বাচিত হলো ‘ওরা ১১ জন’। সিনেমার শুরুতে ছয়টি কামানের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল। ওগুলো ছিল ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের ছয় দফার প্রতীক। ‘ওরা ১১ জন’-এর শুরু সাইফুল ইসলামের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত ‘ও আমার দেশের মাটি’ দিয়ে। আর শেষ সাবিনা ইয়াসমিনের ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ দিয়ে। দেশপ্রেম থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের গাঁথাই গান দুটি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। ‘ওরা ১১ জন’ চলচ্চিত্রে ১১ জন যে যোদ্ধা ছিলেন তাদের মধ্যে একজন শুধু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তার নাম আলতাফ। তিনি খ্যাতিমান অভিনেতা ছিলেন। যদিও যুদ্ধে যাননি, তবে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ছিলেন। একটি মুক্তিযোদ্ধা চরিত্র ছিল যে যুদ্ধে পা হারাবে। এমন অভিনয় সমৃদ্ধ চরিত্র প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে করা যেত না বলে মনে করে তাকে নেওয়া হয়। বাকি সবাই ছিল মাঠের যোদ্ধা। খসরু, ফিরোজ, নান্টু, মুরাদ, অলিন, বেবী, আতা, আবু, হেলাল ও মঞ্জু। একেকজন একেক গ্রুপে যুদ্ধ করেছে। মূলত চলচ্চিত্রে এদের এক সুতায় গেঁথেছিল খসরু। সিদ্দিক জামাল নান্টুকে নিয়ে এসেছিল খসরু। এসে বলেছিল এই ছেলেটা যুদ্ধ করেছে। মাতিয়ে রাখতে পারে পুরো পরিবেশ। ওকে ‘ওরা ১১ জন’ এ নেওয়া যায় না? না করার মতো কিছু দেখিনি। হেলাল ছিল মগবাজারের বড় গুন্ডা। রাজ নামে পরিচিত ছিল। সাহসী যোদ্ধাও ছিল। পেশাদার অভিনেতাদের মধ্যে আছেন রাজ্জাক, শাবানা, নূতন, সৈয়দ হাসান ইমাম, রওশন জামিল, খলিল, মেহফুজ, রাজসহ অনেকে। তারকা শিল্পীরা কেউই পারিশ্রমিক নেননি। ছবির বেশির ভাগ শুটিং হয় জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে। আর্মি মুভমেন্ট, অস্ত্র, গোলাবারুদ সবই ছিল সত্যিকার। ছবিটি বাস্তব করে তোলার ক্ষেত্রে আরেকটি প্রয়াস দেখা যায় যুদ্ধকালীন নিউজ ফুটেজ ব্যবহারে। গণহত্যার ছবি, শরণার্থী শিবিরের দিকে মানুষের ছুটেচলা,
পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ এবং জনগণের বিজয়োল্লাস- সবই একদম প্রথম দিককার এবং বিরল কিছু নিউজ রিল কুশলতার সঙ্গে এ সিনেমায় দেখানো হয়েছে।