উচ্চ সুদের হার, বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং কর্মসংস্থানের সংকট- এই তিন চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও কাঠামোগত দুর্বলতার পরিণতিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতে যে অর্থনৈতিক শ্লথগতি দেখা দিয়েছিল, তার রেশ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। সামপ্রতিক তথ্য বলছে, সামষ্টিক অর্থনীতির কিছু সূচকে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখা গেলেও বিনিয়োগ, শিল্প উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে স্পষ্টভাবেই।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) বার্ষিক প্রকাশনা বাংলাদেশ স্টেট অব দ্য ইকোনমিতে এই চিত্র উঠে এসেছে।
বইটিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের অর্থনীতির হালচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সোমবার রাজধানীর শেরেবাংলানগরের পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলনকক্ষে বাংলাদেশ স্টেট অব দ্য ইকোনমি ২০২৫ ও এসডিজি অগ্রগতি প্রতিবেদন ২০২৫ প্রকাশ ও মতবিনিময় সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন জিইডির সদস্য (সচিব) ড. মনজুর হোসেন। প্রতিবেদনের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অতিরিক্ত সচিব ড. মুনিরা বেগম।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে আসে মাত্র ২ শতাংশে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বাজারে স্থবিরতার প্রভাব সরাসরি পড়ে শিল্প ও সেবা খাতে। একই সময় কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ০.৭৬ শতাংশ, শিল্পে ২.৪৪ শতাংশ এবং সেবায় ২.৪১ শতাংশ।
তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিক থেকে অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি দ্বিতীয় প্রান্তিকে লাফ দিয়ে ৭.১ শতাংশে উঠে আসে, তৃতীয় প্রান্তিকে তা ছিল ৬.৯১ শতাংশ। সার্বিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও তৃতীয় প্রান্তিকে বেড়ে দাঁড়ায় ৪.৯ শতাংশে।
তবু এই পুনরুদ্ধারের পেছনে থাকা গতি এখনো টেকসই নয় বলে বিশ্লেষকদের অভিমত। বিশেষ করে বিনিয়োগ খাতে উচ্চ সুদের চাপ অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক ছয় মাস ধরে নীতি সুদহার ১০ শতাংশে স্থির রেখেছে। এর ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৭ শতাংশের ঘরে। জুন ২০২৫ নাগাদ বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৭.১৫ শতাংশ, যা বিনিয়োগ সম্প্রসারণের জন্য যথেষ্ট নয়। একই সময় সরকারি ঋণ গ্রহণ বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থপ্রবাহ আরো সীমিত হয়েছে, যা কার্যত বিনিয়োগকে কোণঠাসা করে ফেলেছে।
এই বিনিয়োগ সংকোচনের সরাসরি প্রভাব পড়ছে শিল্প উৎপাদনে। শিল্প উৎপাদন সূচক অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিল্প খাতের মোট প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৪.৩ শতাংশ। যদিও অক্টোবর ও ডিসেম্বর মাসে যথাক্রমে ১১.৩৯ ও ১০.৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে, আগস্ট মাসে শিল্প উৎপাদন আবার নেতিবাচক হয়ে যায়। মৌসুমি পুনরুদ্ধার থাকলেও সার্বিকভাবে উৎপাদন খাতে স্থায়ী গতি তৈরি হয়নি। উৎপাদন সম্প্রসারণ না হওয়ায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিও হচ্ছে সীমিত পরিসরে।
এর ফলে কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি আরো উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৬৬ শতাংশে, যা আগের বছর ছিল ৩.৩৫ শতাংশ। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, যুব বেকারত্ব, যা এক বছরে বেড়ে ৭.২৫ শতাংশ থেকে ৮.০৭ শতাংশে পৌঁছেছে। একই সঙ্গে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের বাইরে থাকা (নিট) তরুণদের হার বেড়ে ২০.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর হলেও কর্মসংস্থানের কাঠামো তাতে সাড়া দিচ্ছে না-এই বাস্তবতা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
অর্থনীতির আরো একটি বড় চাপের জায়গা হলো মূল্যস্ফীতি। যদিও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতির হার কমেছে, তবু তা এখনো সাধারণ মানুষের জন্য বড় বোঝা। জুন ২০২৫-এ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি নেমে আসে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে, যা গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে এক অঙ্কে এলেও চালের দাম নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে চালের অবদান জুলাই মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ৫১.৫৫ শতাংশে। মাঝারি চাল একাই খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রায় এক-চতুর্থাংশের জন্য দায়ী। বোরো মৌসুম শেষে উৎপাদন বাড়লেও বাজারে তার প্রভাব পড়েনি।
কৃষি খাতের চিত্র খুব আশাব্যঞ্জক নয়। ২০২৫ অর্থবছরে আউশ ও আমনের উৎপাদন যথাক্রমে ০.৮৫ ও ৬.০৪ শতাংশ কমেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, ঘন ঘন বন্যা ও অনিশ্চিত আবহাওয়া কৃষি উৎপাদনকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে, যা সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর চাপ তৈরি করছে।
এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বাড়তি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে শ্রমবাজার পুনর্গঠনে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে এবং বিনিয়োগ আকর্ষণে বিডার কাঠামোগত সংস্কার ও ইনভেস্টমেন্ট সামিট আয়োজন করা হয়েছে।
তবু বাস্তবতা হলো, উচ্চ সুদে বিনিয়োগের গতি ফিরছে না। শিল্প উৎপাদন কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ছে না, আর এর সবচেয়ে বড় মাশুল দিচ্ছে কর্মসংস্থান। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পথে থাকলেও বিনিয়োগ ও চাকরি সৃষ্টিতে কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া এই পুনরুদ্ধার টেকসই হবে কি না-সেই প্রশ্নই এখন সামনে সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর নিজে দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনীতির চাপ কমাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানান। এর ফলে এতে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পথে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।