বাঁশের তৈরি সুন্দর একটি মাচা। মাচার নিচে উর্বর জমিনে বেশ কিছুদিন পুঁতা ছিল কুমড়োর বীজ। বীজ থেকে উদ্গত অঙ্কুরটি মাথা তুলে আকাশে উঁকি দিল। কচি ও মোলায়েম অঙ্কুরটি চারাতে রূপান্তরিত হলো; উর্বর মাটি, স্নিগ্ধ সুষমায় ভরা হাওয়া ও সকালের সূর্যের মিষ্টি কিরণের সাহায্যে। কুমড়োর চারা উপযুক্ত পরিবেশ, জমিন পেয়ে ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। শাখাপ্রশাখা মেলল। ছড়িয়ে পড়ল ডগাগুলো।
শিশু থেকে কিশোলয়ে পৌঁছতেই কুমড়োর লতাগুলো খুঁটি বেয়ে উঠে গেল মাচার ওপর। কিছুদিনের ভিতর মাচার আনাচে-কানাচে উঁকিঝুঁকি মারল। মাচা দাপিয়ে কুমড়োর লতাগুলো চারপাশে ঝুলে পড়ল।
আরও কিছুদিন পর ডগায় ডগায় ফুল ধরল। ফুলের কলি ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হতে লাগল। ফুল পরিপক্ব হলো, মধু জমল তাতে। ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। মৌ মৌ করে উঠল চারপাশ। ফুলের সৌরভে মুখরিত হয়ে বিভিন্ন পোকামাকড়ের আনাগোনা শুরু হলো কুমড়োর মাচায়।
ফড়িং, প্রজাপতি, মৌমাছিসহ নানা পোকামাকড় ছুটে এলো মধুর টানে।
ছ’পা দিয়ে খুঁটি ও লতা বেয়ে পদচারণ শুরু করল পিঁপড়ের দল। তারা মাচার দিগ্বিদিক মনের সুখে ঘুরে-ফিরে, ছুটে বেড়ায়।
পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গদের পদচারণে মুখরিত হয়ে উঠল কুমড়োর মাচা। আট পা ওয়ালা মাকড়সাদের মাচার নিচে জাল বুনে বেশ আরামেই দিনকাল কাটছিল।
খবর পেয়ে এক দিন মাচার ওপর কুমড়ো ফুলের মধু আহরণে ভ্রমর আসে। তখন থেকেই বাধে যত বিপত্তি। ভ্রমর শুধু যে মধু আহরণ করে এমন নয়। অন্যান্য ছোট প্রাণীর ওপর করে অন্যায়, অত্যাচার।
ভ্রমর যখন কুমড়ো ফুলের মধু আহরণে আসে অন্য পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গদের মধু খাওয়া তো দূর কি বাত, ফুলে বসাও তখন অপরাধ। এমনকি ওদের ক্ষতিসাধনও করে বসে। এক দিন সে ঘোষণাও করে দিল, আমি যখন আসব তখন ফুলে বসা দূরের কথা মাচার ত্রিসীমানায় যেন কেউ না আসে।
তার জোর বলে অন্যরা অসহায়।
এরই মধ্যে ভ্রমরের ভয়ে অনেকে এ মাচা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে অত্যাচারী ভ্রমণের হাতে নির্যাতিত হওয়া থেকে অন্যত্র চলে যাওয়াই শ্রেয়। এমন মনোভাবে চলেও যাচ্ছিল কিছু প্রাণী।
এই পরিস্থিতি দেখে ফড়িং ও প্রজাপতির মাঝে চলছিল গোপন কথোপকথন না, এমনটা হতে দেওয়া যাবে না।
ফড়িং বলল, এক ভ্রমরের উৎপাতে আমরা অতিষ্ঠ। বিষিয়ে তুলেছে জীবন। এত সুন্দর আড্ডা মুখর পরিবেশটাই নষ্ট করে দিল। কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
প্রজাপতি বলল, কেন? অন্যদের মতো আমরাও চলে যাব। এখানে থাকলে প্রাণনাশের আশঙ্কা আছে।
ফড়িং বলল, তাই বলে কি আমরা এমন মনোরম স্থান রেখে চলে যাব!
এদের কথোপকথন শুনে মাচার নিচে সবচেয়ে বড় মাকড়সাটা এগিয়ে এল। ভ্রু কুঁচকে বলল, কী ব্যাপার বলো তো। কদিন ধরে দেখছি মাচার ওপরে বেশ হট্টগোল। চ্যাঁচামেচি। আজ দেখছি অনেকে গাঁটরি-বোঁচকা কাঁধে চলে যাচ্ছে। খবরটা কী?
ফড়িং ও প্রজাপতি বড় মাকড়সাকে সব বুঝিয়ে বলল। ভ্রমরের উৎপাত, অন্য প্রাণীদের আঘাত, কুমড়ো ফুলের মধু আহরণে বাধা ইত্যাদি। সবাই অতিষ্ঠ ভ্রমরের অত্যাচারে। তাই যে যার মতো চলে যাচ্ছে অন্য বাসস্থানের খোঁজে।
সব শুনে বড় মাকড়সা খুব ব্যথিত হলো। এমন সময় এদের পাশ দিয়ে মাচার খুঁটি বেয়ে নেমে যাচ্ছিল লাল পিঁপড়ের দল। বড় মাকড়সা রানি পিঁপড়েকে ডেকে বলল, তোমরা কোথায় যাচ্ছো মাচা ছেড়ে?
রানি শোনাল তার কাহিনি। বলল, সেদিন আমরা কুমড়োর লতাতে ফুলের পাশে পায়চারি করছিলাম। সহসা পাজি ভ্রমরটা কোত্থেকে উড়ে এলো। সবাই দিগ্বিদিক ছোটাছুটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি পাশ কেটে যেই না ছুট দেব এমন সময় দুষ্টুটা আমাকে দিল এক ধাক্কা। ছিটকে পড়লাম মাচার নিচে। ইশ! কি ব্যথা পেয়েছিলাম!
সবার বর্ণনা শুনে বড় মাকড়সা একটা বুদ্ধি আঁটল। ফড়িং ও প্রজাপতিকে সব বুঝিয়ে দিল। কীভাবে কী করতে হবে। লাল পিঁপড়ের দলও যোগ দিল ওদের দলে।
ফড়িং ও প্রজাপতি বড় মাকড়সার কথামতো পরদিন আবার কুমড়োর ফুলের ওপর বসল। অপেক্ষায় রইল ভ্রমরের। কিছু সময়ের ব্যবধানে উড়ে এলো সেই ভ্রমর। ভ্রমর আজ অবাক হয়ে দেখল, তার উপস্থিতি টের পেয়েও ফড়িং ও প্রজাপতি ফুলের মধু আহরণ করছে। ওদের এই দুঃসাহস দেখে ভ্রমর ফুঁসে উঠল। ক্ষোভে ধমকাল। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। এদের স্পর্ধা দেখে রেগেমেগে যেই না তেড়ে এলো অমনি ফড়িং ও প্রজাপতি ফুড়ুৎ করে দিল উড়াল। ভ্রমরও পিছু নিল ওদের।
কুমড়োর পাতার নিচে লুকিয়ে থাকা পিঁপড়েরা মাচার নিচে এসে ঘোষণা দিল। ঘোষণা শুনে বড় মাকড়সা অন্য মাকড়সাদের প্রস্তুত হতে বলল। পরিকল্পনা অনুযায়ী সবাই বসে রইল ফাঁদ পেতে। ফড়িং ও প্রজাপতি উড়ছে পাশাপাশি। উড়তে উড়তে মাচার নিচে পাতা ফাঁদের দিকে আসতে লাগল ওরা। ভ্রমরও ওদের পিছু পিছু ক্ষিপ্ত গতিতে উড়ে আসতে লাগল। ফড়িং ও প্রজাপতি পরিকল্পিত ফাঁদের সামনে এসে দুজন দুদিকে কেটে পড়ল। ভ্রমর তার গতিরোধ করতে না পেরে বড় মাকড়সার পাতা জালে আটকা পড়ল। বড় মাকড়সা তার ফাঁদে একসঙ্গে কয়েক অ্যাঙ্গেলে জাল বুনে রেখেছিল। সেজন্য ভ্রমর আসতেই তার পাখা দুটো ওই মজবুত জালে আটকে গেল। খুব জোর খাটাতে লাগল ভ্রমর। তাতে হিতে বিপরীত হতে লাগল। ভ্রমর যতই মোচড়ামুচড়ি করতে লাগল জালে তার পাখাদ্বয় ততই পেঁচাতে লাগল। এ সুযোগে অন্য সব মাকড়সাও এলোপাতাড়ি জাল বোনায় ফাঁদটা ঢের মজবুত হয়ে উঠল।
ভ্রমর এবার এমন বেকায়দায় পড়ল নড়াচড়ার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলল। কিন্তু অতিরিক্ত জেদ ও অহংকার থাকায় ভ্রমর বেশ জোর খাটাল মাকড়সার বেড়াজাল থেকে পরিত্রাণ পেতে। অতিরিক্ত নড়াচড়ার দরুণ প্রাণ হারায় অত্যাচারী ভ্রমর।
মুহূর্তে খবর রটে পড়ল চারদিকে। ফড়িং, প্রজাপতি ও মাকড়সার ফাঁদে ধরাশায়ী হলো অহংকারী ও অত্যাচারী ভ্রমর। সবাই দূরদূরান্ত থেকে ফিরে এলো কুমড়ো ফুলের মাচায়। হইহই রইরই কলরব ধ্বনি উঠল।
সবাই ধন্যবাদ দিল ওদের। ওরাও বেজায় খুশি এই বিপুল নিরীহ প্রাণীদের সাহায্য করতে পেরে। এমন বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পেরে। আজ থেকে সবাই স্বাধীন। আবার আগের মতো একে অপরের মাঝে ফিরে এলো ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। ঢেউ উঠল আনন্দের। আবার সবাই কুমড়োর মাচাতে সুখে-শান্তিতে থাকতে লাগল।