রাজধানী ঢাকায় কয়েক সপ্তাহ ধরে অগ্নিসন্ত্রাস ও ককটেল বিস্ফোরণের মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে আসছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত একটি সংঘবদ্ধ চক্র। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসে অগ্নিসংযোগসহ একাধিক নাশকতার ঘটনায় এ চক্রের সম্পৃক্ততা শনাক্ত করার পর বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে চক্রটির চারজন সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
গত ৩০ অক্টোবর বিকেলে ধানমন্ডি ২৮ নম্বর সড়কের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইনস্টিটিউটের গলির মুখে নিষিদ্ধ সংগঠনের ব্যানারে মিছিলের প্রস্তুতি চলছিল। ওই সময় ধানমন্ডি থানা পুলিশ আকস্মিক অভিযান চালিয়ে দুইজনকে হাতেনাতে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন হাজারীবাগ-ধানমন্ডি এলাকার পরিচিত যুবলীগ নেতা শওকত ওসমান বাবু ও মিলন খান। গ্রেফতার বাবু ধানমন্ডি ২২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং মিলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি।
পুলিশ জানায়, শওকত ওসমান বাবু দীর্ঘদিন ধরে এলাকাবাসীর ওপর দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগে কুখ্যাত। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর সশস্ত্র হামলাকারীদের অন্যতমও ছিল তিনি। পরবর্তীতে সরকার পতনের সময় বিদেশে পালিয়ে গেলেও সম্প্রতি মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে আসে বহুল মামলার এ আসামি। দেশে ফিরে সে নতুন করে নাশকতার পরিকল্পনা আঁকে। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন ভিডিও, ককটেল বিস্ফোরণের ছবি, বাসে অগ্নিসংযোগের লাইভ ফুটেজসহ নাশকতার নির্দেশনা তার মোবাইল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। হাজারীবাগ বেরিবাধ এলাকায় ১৬ নভেম্বর বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও তার প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ও অর্থায়নে সংঘটিত হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অপরদিকে, গ্রেফতার হওয়া মিলন খান নড়াইলের জয়নগর ইউনিয়নের বাসিন্দা এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় নাশকতা সংগঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছিল বলে তদন্তে জানা গেছে। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি স্বপন ও যুগ্ম আহ্বায়ক সাব্বির শেখের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। মিলন নড়াইল ও গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের এনে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা এলাকার লায়ন টাওয়ারের পেছনের একটি টিনশেড বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিত আর সেখান থেকেই তারা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় নাশকতা ও ঝটিকা মিছিল পরিচালনা করত।
শওকত ও মিলনকে গ্রেফতারের পর তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ধানমন্ডি থানা পুলিশ আরও দুইজনকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে একজন হলেন তাওহিদুল ইসলাম অপু। তিনি হাজারীবাগ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুর রহমান ওয়াকিপ এবং যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক শওকত হোসেন বাবুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। অপু স্বীকার করেছেন যে- তাদের নির্দেশে হাজারীবাগ, ধানমন্ডি ও আশপাশের এলাকায় নাশকতার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। ১৬ নভেম্বর হাজারীবাগ বেরিবাধে বাস পোড়ানোর ঘটনাতেও তার অংশগ্রহণের প্রমাণ স্ক্রিনশটসহ পাওয়া গেছে। শওকত বাবুর কাছ থেকে অপুর বিকাশের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণের তথ্যও উদ্ধার করেছে পুলিশ।
আরেক গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি হলেন সাব্বির শেখ। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। সাব্বির মহানগর যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি স্বপনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। সাব্বির শেখ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যুবলীগ-ছাত্রলীগ কর্মীদের ডেকে এনে ঢাকায় নাশকতায় যুক্ত করতেন। বিভিন্ন টেলিগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সক্রিয় থেকে বাসে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের নির্দেশনা দিতেন। গত ২৮ নভেম্বর ধানমন্ডিতে নিষিদ্ধ সংগঠনের ব্যানারে মিছিলের প্রস্তুতিতেও তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। যদিও সেদিন পালিয়ে যান। পরে পুলিশ ও রমনা বিভাগের টেকনিক্যাল টিম যৌথ অভিযান চালিয়ে কামরাঙ্গীরচর কোম্পানি ঘাট ব্রিজ এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতার ব্যক্তিদের মোবাইল ফোন বিশ্লেষণ করে পুলিশ “আস্তায় শেখ হাসিনা”, “যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণ”, “দরবার হল গ্রুপ”, “বাঙালি বাংলাদেশ”, “২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ”সহ বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপে নাশকতার পরিকল্পনা, ককটেলের ছবি, বিস্ফোরকের তথ্য, অর্থ লেনদেনের প্রমাণ, এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বাসে আগুন দেওয়ার ভিডিও উদ্ধার করেছে। মিরপুর রূপনগর, হাজারীবাগ, ধানমন্ডিসহ কয়েকটি এলাকায় অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাতেও তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে।
পুলিশ জানায়, এ চক্রের আরও কয়েকজন সদস্যকে ইতোমধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে এবং তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। রমনা বিভাগের টেকনিক্যাল টিম ডিজিটাল প্রমাণ সংগ্রহে পুরোপুরি সহযোগিতা করছে।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ