দিনটি বাংলাদেশের হকির জন্য সোনার অক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে। শিরোপা এমনকি কোয়ার্টার ফাইনাল বা টপ সিক্সটিনে খেলা সম্ভব হয়নি। তারপরও বিজয় মাসে বিরল বিজয় পেল বাংলাদেশ। হকির যে কোনো বিশ্বকাপে এবারই প্রথম খেলল বাংলাদেশ। অনূর্ধ্ব-২১ হকির দুনিয়ার কাঁপানো এ আসরে অভিষেকেই বাজিমাত করেছেন যুবারা। অস্ট্রিয়াকে হারিয়ে জুনিয়র বিশ্বকাপে ১৭তম স্থান দখল করেছে বাংলাদেশ। এটি ছিল তৃতীয় ধাপে সেরা হওয়ার লড়াই। যাকে বলা হয়, চ্যালেঞ্জার কাপ। গতকাল ভারতে অনুষ্ঠিত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচে ইউরোপের অস্ট্রিয়াকে ৫-৪ গোলে হারিয়ে চ্যালেঞ্জার কাপের ট্রফি জিতে নিলেন বাংলাদেশের যুবারা। ২৪ দেশের অংশ নেওয়া এ বিশ্বকাপে ১৭তম হওয়াটা নিঃসন্দেহে গৌরবের।
বাংলাদেশ যখন বিশ্বকাপ খেলতে গেল তখন অনেকেরই শঙ্কা ছিল অভিষেক আসরে ভরাডুবি ঘটবে। বিশেষ করে গ্রুপে অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো শক্তিশালী দেশ থাকায় ধারণা করা হয়েছিল প্রতি ম্যাচে গোলে ভেসে যাবেন যুবারা। এটা ঠিক, গ্রুপে কোনো ম্যাচই বাংলাদেশ জিততে পারেনি। তারপরও দারুণ পারফরম্যান্স প্রদর্শন করেছেন আমিরুল, রাকিবুলরা। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৩-৫ ও ফ্রান্সের কাছে ২-৩ গোলে হেরেও প্রশংসিত হয়েছেন যুবারা। গ্রুপসেরা হয়ে ফ্রান্স কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে। অথচ তাদেরই কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন যুবারা। দুর্ভাগ্যক্রমে শেষের দিকে এসে ২-৩ গোলে হেরে যায়। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ৩ গোলে পিছিয়ে থেকেও ৩-৩ ড্র করে। যা ছিল প্রত্যাশার বাইরে।
গ্রুপ পর্বে এমন নৈপুণ্য প্রদর্শন করায় পজিশন ম্যাচ নিয়ে আশাবাদী হয়ে ওঠেন ক্রীড়ামোদীরা। ১৭-২৪তম পজিশন লড়াইয়ে অবিশ্বাস্য নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন আমিরুলের বাংলাদেশ। হ্যাটট্রিক জয়ে সবাইকে পেছনে ফেলে ১৭তম স্থান দখল করে মুখ উজ্জ্বল করেছেন বাংলার দামাল ছেলেরা। হয়তো সামনে আরও বড় সাফল্য আসবে। কিন্তু এ প্রাপ্তিতেই দেশবাসী গর্বিত। যে ওমান বাংলাদেশ জাতীয় দলকে প্রায় হারায়। তাদেরই বয়সভিত্তিক দলকে জুনিয়র বিশ্বকাপে ১৩-০ গোলে উড়িয়ে দেয়। এরপর বিশ্ব হকির অন্যতম পরাশক্তি দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ০-২ গোলে পিছিয়ে থাকার পরও ৫-৩ গোলে জেতাটা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে। কেননা হকিতে এটাই আন্তর্জাতিক আসরে কোরিয়ার বিপক্ষে ছিল প্রথম জয়।
গতকাল ছিল বাংলাদেশ ও অস্ট্রিয়ার অন্যরকম ফাইনাল। যারা জিতবে তারাই চ্যালেঞ্জার কাপ ট্রফি নিয়ে উৎসবে মাতবে। সেটাই করেছেন আমিরুলরা। অস্ট্রিয়া র্যাঙ্কিংয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকায় জয় নিয়ে কিছুটা সংশয় ছিল। আবার এটাও ঠিক যে, যারা অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সের বিপক্ষে লড়াই করে হারে আর দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে জয়লাভ করে সেখানে অস্ট্রিয়াকে ভয় পাওয়ার আর কি আছে? বাস্তবেও হয়েছে তাই। কৌশলী খেলা খেলে ইউরোপের দেশটিকে হারিয়ে ট্রফি নিয়ে ঘরে ফিরছে বাংলাদেশ।
সত্যি বলতে কি চার কোয়ার্টারের ম্যাচে অস্ট্রিয়াও খারাপ খেলেনি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশ টেনশনে ছিল বললেও ভুল হবে না। প্রথম গোল পেতে বাংলাদেশকে প্রথম কোয়ার্টারের শেষ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ১৫ মিনিটে পেনাল্টি কর্নার থেকে গোলের সূচনা করেন আমিরুল ইসলাম। দ্বিতীয় কোয়ার্টারে পেনাল্টি কর্নার থেকে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন হোজাইফা হোসেন। তৃতীয় কোয়ার্টারে রাকিবুল হাসানের ফিল্ড গোলে বাংলাদেশ এগিয়ে যায় ৩-০ গোলে। ৩ গোলে পিছিয়ে যাওয়ার পরই অস্ট্রিয়া জেগে ওঠে। চতুর্থ কোয়ার্টারে ব্যবধান ১-৩ করেন অ্যান্ডোর। ৫০ মিনিটে পেনাল্টি স্টোক থেকে আমিরুল দলের চতুর্থ ও নিজের দ্বিতীয় গোল করেন। ৫১ মিনিটে আবার ব্যবধান কমান অস্ট্রিয়ার বেঞ্জামিন। ৫২ মিনিটে পেনাল্টি স্টোক থেকে বিশ্বকাপে আমিরুল তার পঞ্চম হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন। পরে অস্ট্রিয়া আরও ২ গোল করলেও পরাজয় এড়াতে পারেনি। সত্যি বলতে কি এবারের বিশ্বকাপটি আমিরুলময়। ছয় ম্যাচে তিনি ৫ হ্যাটট্রিক করেন। অভিষেকে হকির যে কোনো বিশ্বকাপে এ কৃতিত্ব কারও নেই। ১৮ গোল করে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোরদাতা আমিরুলই হচ্ছেন তা অনেকটা নিশ্চিত। বাংলাদেশ যদি কোয়ার্টার ফাইনালে যেত তাহলে আমিরুলই হয়ে যেতেন বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়।