টেকসই গণতন্ত্রের জন্য সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।
মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণ : নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এ কথা বলেন।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, একটি রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছিল জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাসহ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রান্ত হলেও সেই স্বপ্ন আজও পূরণ হয়নি। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে এই আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে যে, আর যেন কর্তৃত্ববাদী শাসনের পুনরুত্থান না ঘটে, নির্বাচন ব্যবস্থা যেন পরিশুদ্ধ হয়, গণতন্ত্র যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।
তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক উত্তরণ তথা একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন পূর্বশর্ত হলেও তা যথেষ্ঠ নয়। আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন তথাকথিত ’একদিনের গণতন্ত্র’-ভোট প্রদানের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটে না।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কারণ যদিও নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রাথমিক এবং অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, এটি এককভাবে গণতান্ত্রিক যাত্রাপথকে সুদৃঢ় করতে পারে না। বস্তুত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে টেকসই করতে হলে ‘ডেমোক্রেটিক ডেফিসিট’ বা গণতন্ত্রের ঘাটতি দূর করা আবশ্যক, যার জন্য কতগুলো সুদূরপ্রসারী সংস্কার জরুরি।
তিনি আরও বলেন, বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির গভীর বিশ্লেষণ থেকে আমরা বাংলাদেশে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে মোটাদাগে সাতটি প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করেছি। প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো, নির্বাচনী অঙ্গনে দুর্বৃত্তায়ন, রাজনৈতিক অঙ্গনে দুর্বৃত্তায়ন, নির্বাচনে টাকার অশুভ খেলা, নির্বাচন কমিশনের অকার্যকারিতা, নাগরিক সমাজের নিষ্ক্রিয়তা, নির্বাচনকালীন সরকারের পক্ষপাতদুষ্টতা এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও ভারসাম্যহীনতা।
তিনি বলেন, জটিল এবং ক্রমবর্ধমান এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করার ওপরই নির্ভর করবে ভবিষ্যতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণ। আর এর জন্য প্রয়োজন হবে কতগুলো গভীর আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অতীতের জালিয়াতি ও বিতর্কিত নির্বাচনের জন্য দায়ী মূলত নির্বাচনকালীন সরকারের পক্ষপাতদুষ্টতা, নির্বাচনী অঙ্গনে দুর্বৃত্তায়ন, রাজনৈতিক অঙ্গনে দুর্বৃত্তায়ন, টাকার অশুভ প্রভাব, নির্বাচন কমিশনের অপারগতা, নাগরিক সমাজের অক্ষমতা ও ক্ষমতার বিদ্যমান ভারসাম্যহীনতা তথা নজরদারিত্বের কাঠামোর দুর্বলতা।
তিনি বলেন, তাই ভবিষ্যতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিশ্চিত করতে হলে এসব বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া এবং কতগুলো সুদূর প্রসারী আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ আবশ্যক।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ স্বাক্ষর ও সরকারের পক্ষ থেকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সাংবিধানিক সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ জারির মাধ্যমে এসব সংস্কারের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। তবে কাঙ্ক্ষিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হলেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত হবে না। টেকসই গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন।
সুজন সহ-সভাপতি বিচারপতি এম এ মতিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আরও বক্তব্য রাখেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. দিলারা চৌধুরী, আলোকচিত্রী ড. শহীদুল আলম, লেখক ও সাবেক সচিব আবদুল আউয়াল মজুমদার, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমীন টুলী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. একেএম ওয়ারেসুল করিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ, ডা. হালিদা হানুম আখতার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ মোহাম্মদ সাহান ও ভয়েস ফর রিফর্ম-এর অন্যতম উদ্যোক্তা ফাহিম মাশরুর।
বিডি প্রতিদিন/এমআই