সর্বনাশা আগুনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে থাকা আইরিনের ঘর। পুড়ে অঙ্গার হওয়া টিনের ভাঁজে খুঁজেছেন তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসারের জিনিসপত্র। কিন্তু ছাই ছাড়া মেলেনি কিছুই। সম্বল বলতে পরনের কাপড়। থাকবেন কোথায়? খাবেন কী? সেই চিন্তায় কান্না করছেন পুড়ে ছাই হওয়া ঘরের এককোণে বসে। মাটি কাটা শ্রমিক হিসেবে কাজ করা মানিকজানের ঘরের মাঝখানে প্লাস্টিকের ছোট্ট একটি ওয়্যারড্রব ছিল। এর ভিতরে ছিল শিশুকন্যার একটি মাত্র সোনার চেইন। তাই পঞ্চাশোর্ধ্ব মানিকজান ওয়্যারড্রব রাখার জায়গায় কাঁচি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চেইনটি খুঁজছেন। লোকজন তাকে বারবার বলছেন, চেইনটি পাওয়া যাবে না। কিন্তু তা মানতে নারাজ মানিকজান। ছাইয়ের মধ্যে খুঁজেই বেড়াচ্ছেন তিনি। শুধু আইরিন ও মানিকজানই নন তার মতো আগুনে সবহারা পরিবারগুলো গতকাল ছাইয়ের মধ্যে অবশিষ্টাংশ খুঁজে বেড়ান। কেউ কেউ এক কাপড়ে খোলা আকাশের নিচে সন্তানদের নিয়ে অবস্থান করছেন। সবকিছু গুছিয়ে ওঠার আগপর্যন্ত খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় ও খাবার জুটবে কীভাবে? সেই চিন্তায় সবার মধ্যেই যেন ভর করেছে বিষণ্নতা কালো মেঘ। অনেকেই ঘর হারানোয় কান্না করছেন। তবে কয়েকটি রাজনৈতিক দল থেকে রুটি-কলা আর খিচুড়ি দিয়ে সাময়িক সহায়তা করা হচ্ছে। আগুনে পুড়েছে বস্তিতে থাকা বিদ্যালয়ও। এতে শিশুদের পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সর্বনাশা আগুনের লেলিহান শিখায় বস্তির ১৫০০ ঘর পুড়ে যাওয়ার তথ্য জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
তবে বস্তিবাসীর দাবি, এই সংখ্যা আরও বেশি। ২ হাজারের বেশি ঘর পুড়ে গেছে। আগুন লাগার সূত্রপাত সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস নিশ্চিত হতে পারেনি। তবে বস্তির একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, খেলনা দোকানের মালিক মিন্টু মিয়ার রান্নাঘরের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো বস্তিতে। গত মঙ্গলবার রাতে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো জ্বলতে থাকা সেই আগুন ১৯টি ইউনিটের পুরোপুরি নির্বাপণে আসে ১৬ ঘণ্টা পর। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে এই কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে সরকার সহায়তা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এদিকে আগুন লাগার খবরে ঘটনাস্থলে সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে জাগো ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী দ্বারা হয়রানি হওয়ার অভিযোগ করেন গণমাধ্যমকর্মীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বস্তির বউবাজারের কুমিল্লা পট্টি, বরিশাল পট্টি ও ‘ক’ ব্লক এলাকায় আগুন লাগে। ওই অংশে এক তলা ও দোতলা সিস্টেমের সেমিপাকা প্রায় দুই হাজারের মতো ঘর ছিল। আগুনে সব ঘর পুড়ে গেছে। শুধু খোপ খোপ দেয়াল পড়ে আছে। বস্তিটির মূল সড়কসহ অলিগলিতে ছিল মুদি দোকান, টেইলার্সের দোকান, খাবার দোকান, ভাঙারিসহ হরেক রকমের দোকান। এসব পুড়ে একাকার হয়ে গেছে। একাধিক বাসিন্দার মতে, বস্তিতে প্রায় প্রতিবছর একাধিকবার ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গত ২৫ বছরের মধ্যে অন্তত ২০ বার আগুনের ঘটনা দেখেছেন বলে বেশ কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন।
অন্যদিকে বস্তিতে লাগা আগুনে ঘরের সঙ্গে পুড়েছে অনেক বাসিন্দার সারা জীবনের সঞ্চয়। ভবিষ্যতের আশায় তিল তিল করে জমানো সঞ্চয় পুড়ে ছাই হয়েছে। অনেকে মাটির ব্যাংক ও টিনের কৌটায় জমিয়েছিলেন টাকা। সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় জমানো টাকা পুড়ে ছাই হয়েছে চোখের পলকে। স্থানীয় মুদি দোকান কর্মচারী ফারুক হোসেন টিনের কৌটার ভিতরে ঘর মেরামতের জন্য জমানো দেড় লাখ টাকা ধ্বংসস্তূপের ছাইয়ের সঙ্গে মিশে গেছে। ‘ক’ ব্লকের সেই পোড়া ভিটায় গিয়ে ফারুক হোসেন যখন মাটি হাতড়ে তার জমানো টাকা খুঁজছিলেন, তখন কেবল পোড়া কয়লা আর আধাপোড়া নোটের টুকরো ছাড়া আর কিছুই মেলেনি। ফারুক বিলাপ করে জানান, কষ্ট করে, না খেয়ে দেড় লাখ টাকা জমিয়েছিলাম। গায়ের কাপড় ছাড়া আমার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আরেক বাসিন্দা রাজিব হোসেন বলেন, চোখের পলকেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে ছোট একটি আগুন দেখেছিলাম, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই পুরো ঘর লেলিহান শিখায় জড়িয়ে যায়। চারদিক ধোঁয়া আর আগুনে অন্ধকার হয়ে আসে। তখন আর কিছু বাঁচানোর মতো সময় ছিল না। প্রাণ বাঁচাতে সবাই কোনো রকমে বাইরে বেরিয়ে আসি। কেউই কল্পনা করতে পারেনি এত দ্রুত সব শেষ হয়ে যাবে। বাইরে এসে দাঁড়িয়ে শুধু আগুনে পুড়তে থাকা ঘর দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না।
আগুন লাগার পেছনে সরকারই দায়ী : বস্তিতে আগুনের পেছনে সরকারকে দায়ী করেছে বস্তিবাসী পুনর্বাসন ও শহীদ পরিবারের ক্ষতিপূরণ আদায়ের সংগ্রাম পরিষদ। গতকাল রাজধানীর তেজকুনিপাড়ায় এক সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের সভাপতি আবদুর রহিম এই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, বস্তিবাসীদের উন্নয়নসহ দুই দফা দাবিতে চার মাস ধরে সংগ্রাম করে আসছি। সরকার কর্ণপাতই করছে না। কড়াইল বস্তিতে আগুন লেগেছে। কাল আরেক বস্তিতে আগুন লাগবে। আমাদের সরকার কী করছে? আমরা যেখানে বারবার বলছি সারা দেশের বস্তি পুনর্বাসন করা সম্ভব সরকারি টাকা ছাড়াই ভাষানটেক প্রকল্পের ন্যায়। তিনি বলেন, বস্তিবাসীদের বাঁচাতে হলে দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বস্তিবাসীর পাশে দাঁড়াতে হবে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে অবহেলিত এবং অনিরাপদে রেখে বাংলাদেশ কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।