আনতাকিয়া পৃথিবীর প্রাচীনতম নগরীগুলোর অন্যতম। আনতাকিয়া আধুনিক তুরস্কের অংশ। প্রাচীনকালে তা শামের অংশ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে অরন্তিস নদীর তীরে শহরটির গোড়াপত্তন করেন সেলিউকাস প্রথম নিকাতর।
তিনি ছিলেন গ্রিক বীর আলেকজেন্ডারের সেনাপতি। ভূমধ্য সাগর থেকে শাম ও পারস্য অঞ্চলে যাতায়াতকারী বাণিজ্য কাফেলা এই শহরের ওপর দিয়েই অতিক্রম করত। ফলে অল্পদিনেই তা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। শামের প্রবেশ মুখে অবস্থান হওয়ায় আনতাকিয়ার সামরিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বও ছিল অপরিসীম।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৬৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শহরটি গ্রিকদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। এরপর শহরটি রোমান ও সাসানিদদের দখলে যায়। পরবর্তী সময়ে বাইজেন্টাইনদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে বাইজেন্টাইনদের পরাজিত করে মুসলিম বাহিনী আনতাকিয়া জয় করে।
কোরআনের বর্ণনায় আনতাকিয়া
পবিত্র কোরআনে সুরা ইয়াসিনের ১৩ নম্বর আয়াত থেকে ৩২ নম্বর আয়াত পর্যন্ত প্রাচীন এক নগরীতে দ্বিন প্রচারের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। ঘটনার শুরুতে বলা হয়েছে, ‘তাদের কাছে বর্ণনা কোরো এক জনপদের অধিবাসীদের দৃষ্টান্ত; যখন তাদের কাছে এসেছিল রাসুলগণ। যখন তাদের কাছে পাঠিয়েছিলাম দুই রাসুল, তখন তারা তাদের মিথ্যাবাদী বলেছিল। অতঃপর আমি তাদের শক্তিশালী করেছিলাম তৃতীয় একজন দ্বারা। তারা বলেছিল, আমরা তো তোমাদের কাছে প্রেরিত হয়েছি।
তারা বলল, তোমরা আমাদের মতই মানুষ, দয়াময় আল্লাহ কিছুই অবতীর্ণ করেননি। তোমরা কেবল মিথ্যাই বলছ।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত : ১৩-১৫)
আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর সূত্রে বলেন, জনপদের নাম ছিল আনতাকিয়া। যার শাসক ছিল মূর্তিপূজক। ঈসা (আ.) মহান আল্লাহর নির্দেশে সেখানে তাঁর তিনজন সহচর পাঠান। তাদের নাম ছিল ইউহানা, বুলুচ ও শামউন। ইবনে ইসহাক (রহ.) বলেন, তারা সরাসরি নবী ছিলেন। তাদের নাম ছিল সাদেক, সুদুক ও শুলুম। আনতাকিয়া শহরের কেউ কেউ রাসুলদের প্রতি ঈমান আনলেও বেশির ভাগ মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করে। শহরবাসী রাসুলদের হত্যা করতে উদ্ধত হলে হাবিব বা হাবিবে নাজ্জার নামক এক ব্যক্তি সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেন। কিন্তু শহরবাসী উল্টো তাঁকে হত্যা করে। তখন আল্লাহ তাদের বিকট শব্দের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেন। (তাফসিরে ইবনে কাসির)
রোমান সম্রাজ্যের শাসনামলে আনতাকিয়া শহরে খ্রিস্টধর্মের প্রসার ঘটে। এখানে খ্রিস্টধর্মের প্রাচীনতম গির্জাগুলোর একটি অবস্থিত। সুপ্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত আনতাকিয়া বহুবার ভয়াবহ ভূমিকম্পের শিকার হয়েছে।
আনতাকিয়ায় মুসলিম শাসন
খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যুগে মুসলিম বাহিনী আনতাকিয়া জয় করে। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে জাসরুল হাদিদ যুদ্ধে বিজয় লাভের মাধ্যমে শহরটি মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আসে। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.)। উমাইয়া খেলাফতের সময় আনতাকিয়াকে অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র ও সামরিক ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলা হয়। আব্বাসীয় যুগেও শহরটি তাঁর প্রভাব ও মর্যাদা ধরে রাখে। সে সময় শহরটি আব্বাসীয় খেলাফতের ধর্মীয় সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। এখানে মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিরা শান্তিপূর্ণ সহবাস্থান করত।
৪৯১ হিজরি মোতাবেক ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডারদের কাছে শহরের নিয়ন্ত্রণ চলে যায়। দীর্ঘ ১১ মাস অবরোধ করে রাখার পর তারা শহর দখলে সক্ষম হয়। তারা শহর থেকে ইসলামের যাবতীয় চিহ্ন মিটিয়ে ফেলে বহু মসজিদকে গির্জায় পরিণত করে। শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১২ মাইল দীর্ঘ প্রাচীর নির্মাণ করে। যাতে ১২০টি প্রতিরক্ষা টাওয়ার এবং ২৪ হাজার বেলকনি ছিল। দিন-রাত প্রহরী সেখানে অবস্থান করত। ক্রুসেডাররা প্রায় ১৭০ বছর আনতাকিয়া দখল করে রাখে। ৬৬৬ হিজরি মোতাবেক ১২৬৭ খ্রিস্টাব্দে মামলুক শাসক সুলতান জহিরুদ্দিন বাইবার্স আনতাকিয়া উদ্ধার করেন। তিনি তাঁর বাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করেন। যার এক ভাগ সমুদ্র পথ অবরোধ করে, এক ভাগ ইউরোপীদের সাহায্য পাঠানোর স্থল পথ অবরোধ করে এবং তৃতীয় ভাগ তাঁর নেতৃত্বে শহর অবরোধ করে। ১৪ রমজানে তিনি বিজয় লাভ করেন।
১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে মামলুকদের কাছ থেকে শহরের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় উসমানীয়দের হাতে। তুর্কিরা শহরটিকে আবারও আধুনিক বাণিজ্য কেন্দ্রে রূপান্তরিত করে। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে উসমানীয়দের পরাজয় হলে ১৯১৮ সালে আনতাকিয়া ফরাসি ম্যান্ডেটে চলে যায়। ১৯৩৯ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে আনতাকিয়া আধুনিক তুরস্কে যোগদান করে। আনতাকিয়া এখন তুরস্কের অন্যতম পর্যটন প্রিয় শহর এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমৃদ্ধ নগরী। অবশ্য ২০২৩ সালের ভূমিকম্পে আনতাকিয়ার প্রাচীন স্থাপনাগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সূত্র : ইসলাম ওয়েব ডটনেট, আল জাজিরা ও ব্রিটানিকা ডটকম
বিডি প্রতিদিন/মুসা