আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মধ্যে মৌলিক আকিদা-বিশ্বাস নিয়ে কোনো প্রকারের মতবিরোধ নেই। শুধু শাখাগত কিছু আকিদার বিষয়ে সামান্য মতপার্থক্য রয়েছে, যেগুলো নিতান্ত গৌণ বিষয়। শাখাগত মাসায়েল ও বিধানসমূহের ক্ষেত্রে যেমন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মধ্যে চারটি মাজহাব আছে—হানাফি, মালেকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি, তদ্রূপ শাখাগত কিছু মতপার্থক্য থাকায় আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মধ্যে আকিদাবিষয়ক তিনটি মাজহাব রয়েছে—মাতুরিদি, আশআরি ও সালাফি। উক্ত তিন মাজহাবই হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং সবাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত।
ইমাম আবু মানসুর মাতুরিদি (রহ.) ও আবুল হাসান আশআরি (রহ.) এবং তাঁদের অনুসারীরা যে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত।
ইমাম আবু মানসুর মাতুরিদি (রহ.)
ইমাম মাতুরিদির নাম মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ বিন মাহমুদ। উপনাম আবু মানসুর। সমরকন্দের নিকটবর্তী ‘মাতুরিদ’ নামক মহল্লার অধিবাসী ছিলেন।
সেদিকে সম্পৃক্ত করেই তাঁকে মাতুরিদি বলা হয়। বিভিন্ন শক্তিশালী আলামত থেকে বোঝা যায়, ২৪০ হিজরির কাছাকাছি সময়ে তাঁর জন্ম। ওফাত হয়েছে ৩৩৩ হিজরিতে।
ইমাম আবু মানসুর মাতুরিদি (রহ.)-এর ইলমের সূত্র ইসলামের সোনালি যুগের ইমামদের সঙ্গে যুক্ত।
তিনি ইসলামী আকাইদ, হাদিস, তাফসির, ফিকহর ইলম আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ইমামদের হাসিল করেছেন। আর আমৃত্যু এই নির্ভরযোগ্য ইলম তাঁর কিতাবগুলোতে প্রচার করে গিয়েছেন।
তাঁর মূল ব্যস্ততা ছিল বিভিন্ন ভ্রান্ত ফেরকার খণ্ডন করা এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের পথ ও আদর্শকে দলিলের মাধ্যমে শক্তিশালী করা। সে জন্যই মুসলিম উম্মাহ তাঁকে ‘ইমামুল হুদা’ উপাধিতে স্মরণ করে। তাঁকে কিতাবসমূহের মধ্যে ‘তাবিলাতু আহলিস সুন্নাহ’ ও ‘কিতাবুত তাওহিদ’ কিতাবদ্বয় মুদ্রিত রয়েছে। (আজাওহিরুল মুজিআ ২/১৩০)
ইমাম আবুল হাসান আশআরি (রহ.)
ইমাম আশআরি (রহ.)-এর নাম আলী ইবনে ইসমাঈল। উপনাম আবুল হাসান। নবীজি (সা.)-এর সাহাবি আবু মুসা আশআরি (রা.)-এর বংশধর। জন্ম ২৬০ হি., আর ওফাত ৩২৪ হি.। বসরার অধিবাসী।
আহলুস সুন্নাহ আশআরি বা মাতুরিদি কেন?
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকিদা নবীজি (সা.) ও সাহাবিদের সুন্নতের
বাস্তবরূপ। চতুর্থ শতাব্দী থেকে এই আকিদার অনুসারী অধিকাংশ মানুষকে আশআরি বা মাতুরিদি বলা হয়। এর কারণ হলো, আহলে সুন্নতের আকিদার সংরক্ষণ এবং এ বিষয়ে উদ্ভূত বিভিন্ন বাতিল ফেরকার খণ্ডনে এই দুই ইমাম অধিক পরিচিতি লাভ করেন। মুসলিম উম্মাহ তাঁদের এই খেদমত গ্রহণ করে। সে জন্য তাঁদের অনুসারীরা ‘মাতুরিদি’ বা ‘আশআরি’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। ইমাম বায়হাকি (রহ.)সহ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক মুহাক্কিক আলেমরা তা স্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন। (দেখুন—তবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা ৩/ ৩৯৫-৩৯৯)
ইরাক, শাম ও খোরাসানের হানাফি আলেমগণের অধিকাংশ মাতুরিদিই ছিলেন। তবে যেহেতু আশআরি ও মাতুরিদি মাসলাকের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নেই, তাই হানাফিদেরও সাধারণত আশআরি বলা হয়; বিশেষত যেসব অঞ্চলে ইমাম আশআরি (রহ.)-এর এলেম অধিক প্রচারিত হয়েছে। কারণ সেখানে তিনিই ছিলেন ‘সুন্নাহ’র নিদর্শন। তাই পুরো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতকে তাঁর দিকেই সম্বন্ধ করা হতো।
আহলুস সুন্নাহ আশআরি বা মাতুরিদির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ ইমাম মাতুরিদি ও আশআরি (রহ.) এবং তাঁদের অনুসারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁদের উভয়ের জন্ম হিজরি তৃতীয় শতকে আর ওফাত চতুর্থ শতকে। অথচ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের প্রথম জামাত হলেন সাহাবায়ে কেরাম। দ্বিতীয় জামাত তাবিয়িন, আর তৃতীয় জামাত তাবে তাবেয়িন। অতঃপর সব ইসলামী শহর ও অঞ্চলে যেসব মনীষী ও তাঁদের অনুসারীরা ঈমান-আকিদা ও নীতি-আদর্শে সোনালি যুগের মনীষীদের পথে রয়েছেন তাঁরা সবাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অংশ; আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ বললে তাঁরাও উদ্দেশ্য। ইমাম মাতুরিদি ও আশআরি তাঁদের পূর্ববর্তী এই মনীষীগণের মাধ্যমেই দ্বিন-শরিয়তের সঠিক ও নির্ভরযোগ্য জ্ঞান অর্জন করেছেন।
এটা স্বাভাবিক যে আশআরি-মাতুরিদি ধারার অনুসারী মানুষের সংখ্যা বিপুল হওয়া সত্ত্বেও এমন আলেমও পাওয়া যাবে, যাঁরা ও তাঁদের অনুসারীরা নীতি ও আদর্শে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অনুসারী, তবে তাঁরা আশআরি-মাতুরিদি নামে পরিচিত নন। (ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন ২/৬-৭)
বিডি প্রতিদিন/মুসা