অন্তর্বর্তী সরকার গঠন ও শপথের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ করে করা রিট খারিজের বিরুদ্ধে করা লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি) আবেদন পর্যবেক্ষণসহ খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। গতকাল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদেশে সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, হাই কোর্টে রিট আবেদনটি সরাসরি খারিজের সিদ্ধান্ত যথার্থ ছিল। হাই কোর্টের খারিজ আদেশে কোনো রকম হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। ফলে লিভ টু আপিলটি খারিজ করা হলো। এ আদেশের পর অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। তারা বলেছেন, ‘আপিল বিভাগ পর্যবেক্ষণসহ লিভ টু আপিল খারিজ করে দিয়েছেন। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন ও তাদের কার্যক্রমের বৈধতা নিয়ে আর প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। নিশ্চয়ই সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা-পর্যালোচনা থাকবে।’
গণ অভ্যুত্থানের মুখে গত বছর ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। সেদিন ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমন পরিস্থিতিতে ৬ আগস্ট সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে মতামত চান রাষ্ট্রপ্রধান। এ মতামত চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ৮ আগস্ট মতামত দিলে তার ভিত্তিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে এ মতামত নেওয়ার প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ মহসিন রশিদ। রিট আবেদনে বলা হয়, সংবিধানে নেই, এমন বিষয়ে রেফারেন্স (মতামত) চাওয়া যায় না। তা ছাড়া সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে আপিল বিভাগকে সুপ্রিম কোর্টের রুলস অনুসরণ করে অ্যাটর্নি জেনারেল ও অন্যদের নোটিস দিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শুনানি করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠন এবং শপথ নিয়ে শুনানির জন্য নোটিস দেওয়া হয়নি। প্রাথমিক শুনানির পর গত ১৩ জানুয়ারি রিটটি সরাসরি খারিজ করে দেন বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজীর হাই কোর্ট বেঞ্চ। পরে ৯ ফেব্রুয়ারি পূর্ণাঙ্গ আদেশটি প্রকাশ করা হয়। ৯ পৃষ্ঠার আদেশে বলা হয়, রিট আবেদনটি কেবল ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করেই করা হয়নি, আবেদনটি উসকানিমূলকও। এতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধান এখনো কার্যকর এবং সম্পূর্ণভাবে সক্রিয়। পরে এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন (লিভ টু আপিল) করেন মহসিন রশিদ। গত ২ নভেম্বর এই আবেদনের প্রথম শুনানির পর ৬ নভেম্বর ফের শুনানি হয়। এরপর শুনানি মুলতবি ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় গত ২ ও ৩ ডিসেম্বর শুনানির পর গতকাল আবেদনটি পর্যবেক্ষণসহ খারিজ করে আদেশ দিলেন আপিল বিভাগ।
আদালতে লিভ টু আপিলের পক্ষে আবেদনকারী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ মহসিন রশিদ নিজেই শুনানি করেন। ইন্টারভেনার হিসেবে যুক্ত হওয়া লেখক ফিরোজ আহমেদের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া, ইন্টারভেনার নওগাঁর বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এ এস এম শাহরিয়ার কবির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ অনীক আর হক। এ ছাড়া ইন্টারভেনার হিসেবে শুনানি করেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। মতামত নেওয়া, না নেওয়ার ওপর সরকারের বৈধতা নির্ভর করে না :
আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ থাকা, না থাকার ওপর, ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতির মতামত নেওয়া, না নেওয়ার ওপর একটি বিপ্লবী সরকারের বৈধতা-অবৈধতা নির্ভর করে না। রাষ্ট্রপতি যদি মতামত নাও নিতেন তারপরও এই বিপ্লোত্তর সরকার বৈধতার মুখে পড়বে না। যদি বৈধতার মুখে পড়ে, তবে মুক্তিযুদ্ধত্তোর বাংলাদেশ, নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশ এ দুটো প্রশ্নের মুখে পড়বে। সেই সময়ের রাজনৈতিক সরকারগুলো প্রশ্নের মুখে পড়বে।’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সোশ্যাল কন্টাক্ট থিওরিতে এবং রেভল্যুশনারি থিওরিতে যারা বিজয়ী শক্তি, বিজয়ত্তোর পরিবেশে দেশ কীভাবে চলবে, দেশের আইন কীভাবে চলবে, দেশের নির্বাচন কীভাবে চলবে সেটা নির্ধারণ করে। জুলাই গণ অভ্যুত্থান উত্তর বাংলাদেশে বিজয়ী শক্তি মনে করেছে, বাহাত্তরের সংবিধানকে ভিত্তি ধরে বিদ্যমান সংবিধানের সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন-বিয়োজন করবে। যে কারণে জুলাই ঘোষণাপত্র আনা হয়েছে। যে কারণে সাংবিধানিক আদেশ জারি করা হয়েছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। গণ অভ্যুত্থানে বিজয়ী শক্তি যেভাবে সিদ্ধান্ত নিবে, তারা সেভাবেই এগিয়ে যাবে।’