উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন নেওয়া হচ্ছে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ সকালের মধ্যেই তাঁকে নিয়ে চিকিৎসক দলের লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা। কাতারের আমিরের দেওয়া (বিশেষায়িত উড়োজাহাজ) রয়্যাল এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে অসুস্থ নেত্রীকে লন্ডন নেওয়া হবে। বেগম জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান লন্ডন থেকে ঢাকায় আসছেন আজ। সকাল সাড়ে ৯টায় বিমানবন্দরে নেমেই তিনি সরাসরি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে যাবেন। হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন বেগম খালেদা জিয়াকে আইসিইউ অ্যাম্বেুলেন্সে করে বিমানবন্দরে নিয়ে যাবেন জুবাইদা রহমান। এরপর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করবেন তারা। চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাতজন চিকিৎসক ও দুই পুত্রবধূসহ ১৫ জন সহযাত্রী হচ্ছেন। এর মধ্যে এসএসএফের দুজন সদস্যও রয়েছেন। বিশেষায়িত এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে কাতারের নিজস্ব চিকিৎসক ও নার্সের একটি দলও থাকছে। ‘অত্যন্ত সংকটাপন্ন’ অবস্থায় বর্তমানে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি।
বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন যাত্রা উপলক্ষে গতকাল সন্ধ্যার পর থেকেই ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার বিষয়টি স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) সদস্যরা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর শারীরিক অসুস্থতার জটিলতা এখনো কাটেনি। তবে মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উন্নত ও সুচিকিৎসার জন্য তাঁকে অ্যাডভান্স হেলথকেয়ার সেন্টারে নেওয়ার এখনই সময়। তাঁর সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনায় দলের পক্ষ থেকে আজ বাদ জুমা সারা দেশে মসজিদে দোয়া ও মোনাজাত এবং মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রার্থনা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জাফর মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন গতকাল দুপুরে খালেদা জিয়ার লন্ডন যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
জানা যায়, গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর গুলশানে এভারকেয়ার হাসপাতালে বৈঠকে বসে খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ড। এতে যুক্তরাজ্য ও চীন থেকে আসা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অংশ নেন। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে ভার্চুয়ালি আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠক শেষে বেলা পৌনে ৩টার দিকে হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন ডা. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড দেশমাতাকে উন্নত চিকিৎসার্থে লন্ডনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর বর্তমান শারীরিক অবস্থার আলোকে যদি সবকিছু ঠিক থাকে কাতার রয়্যাল এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পরে অথবা আজ শুক্রবার সকালের ভিতরে ইনশাল্লাহ যুক্তরাজ্যে অর্থাৎ লন্ডনের নির্ধারিত হসপিটালে তাঁকে নিয়ে যাব। তাঁর সঙ্গে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে বেশ কয়েকজন দেশি চিকিৎসক এবং বিদেশের দুজন চিকিৎসক থাকবেন। মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শক্রমে যাতে যাত্রাপথে তাঁর কোনো ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে সুস্থভাবে উড়োজাহাজে চিকিৎসা দেওয়া যায়, সেই লক্ষ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে আমরা ইনশাল্লাহ তাঁকে দেশের বাইরে নিয়ে যাব। দেশনেত্রীর সুস্থতার জন্য দেশবাসীসহ দেশের বাইরে হাজার-লাখো মানুষের কাছে দোয়া চাই। যারা এত দিন তাঁর সুস্থতায় দোয়া করেছেন, তাদের সবার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আপনাদের এ দোয়া-ই ম্যাডামকে সুস্থ করে তুলবে। আমরা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তাঁর সহধর্মিণী ডা. জুবাইদা রহমান এবং তাঁর কন্যা ব্যারিস্টার জাইমা রহমান, দেশনেত্রীর ছোট ছেলের সহধর্মিণী সৈয়দা শামিলা রহমান, তাঁদের দুই কন্যা জাফিয়া ও জাহিয়া রহমান, তাঁর ছোট ভাই শামীম এস্কান্দারসহ তাঁদের আত্মীয়স্বজনের পক্ষ থেকেও সবার কাছে দোয়া চাই এবং দেশবাসীকে কৃতজ্ঞতা জানাই।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টা, সেনাবাহিনীসহ তিন বাহিনী প্রধান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এভারকেয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, চিকিৎসক-নার্সসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী, চীন, রাশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, ভারত, পাকিস্তান হাইকমিশনের সব ধরনের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন অধ্যাপক ডা. জাহিদ হোসেন।
‘খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে কি না?’ এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. জাহিদ বলেন, ‘আমরা মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শের বাইরে কোনো কিছু চিন্তা করছি না। মেডিকেল বোর্ড গতকাল তিনবার ভার্চুয়ালি বৈঠক করেছে। ফিজিক্যালি দেখছেন যুক্তরাজ্য ও চীনের ডাক্তারগণ। আমরা আল্লাহর রহমতে আশাবাদী যে, ইনশাল্লাহ দেশনেত্রী খালেদা জিয়া আল্লাহর অশেষ রহমতে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, এবারও ইনশাল্লাহ উনি আমাদের মাঝে সুস্থ হয়ে ফেরত আসবেন।’
এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সাত চিকিৎসকসহ থাকছেন ১৫ জন : লন্ডন যাওয়ার সময় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সাত চিকিৎসকসহ থাকবেন ১৫ জন। তাঁরা হলেন পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শামিলা রহমান, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. জাহিদ হোসেন, ডা. এনামুল হক চৌধুরী (চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা), বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী, অধ্যাপক ডা. সাহাবুদ্দিন তালুকদার, অধ্যাপক ডা. নুরুদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাফর ইকবাল, ডা. মোহাম্মদ আল মামুন, হাসান শাহরিয়ার ইকবাল (এসএসএফ), সৈয়দ সামিন মাহফুজ (এসএসএফ), আবদুল হাই মল্লিক (ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সহকারী), মাসুদুর রহমান (অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রাইভেট সেক্রেটারি), ফাতেমা বেগম (গৃহকর্মী) ও রুপা শিকদার (গৃহকর্মী)।
২৩ নভেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরায় এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন বেগম খালেদা জিয়া। ২৭ নভেম্বর থেকে তিনি হাসপাতালটির করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। তাঁর শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত। তবে চিকিৎসকদের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন তিনি। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ও তত্ত্বাবধানে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তাঁর চিকিৎসা চলছে। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানান, ফুসফুসে স্বাভাবিকভাবে বাতাস চলাচল করানোর জন্য বুধবার রাতে হাসপাতালের চতুর্থ তলায় মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশনে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। কিডনি কার্যক্রম সচল রাখতে সেদিন বিকালেও ডায়ালাইসিস করা হয়েছে।
এর আগে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেওয়া হয় কাতারের আামির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির দেওয়া (বিশেষায়িত উড়োজাহাজ) রয়্যাল এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে। সেখানে লন্ডন ক্লিনিক হসপিটালে চিকিৎসা নেন তিনি। চার মাস চিকিৎসা শেষে ৫ মে কাতারের আমিরের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সেই দেশে ফেরেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
ঢাকায় আসছেন ডা. জুবাইদা রহমান : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানের লন্ডন থেকে রওনা হয়ে আজ সকালে ঢাকায় পৌঁছানোর কথা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি বিমানে সকাল সাড়ে ৯টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন। বিমানবন্দর থেকে তিনি সরাসরি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে যাবেন। এরপর হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন বেগম খালেদা জিয়াকে আইসিইউ অ্যাম্বেুলেন্সে করে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে যাবেন জুবাইদা রহমান। সবশেষ বিমানবন্দর থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করবেন তারা।
বেগম খালেদা জিয়ার এ চিকিৎসা-প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন ডা. জুবাইদা রহমান, যিনি লন্ডন থেকে সার্বিক চিকিৎসা বিষয়ে সমন্বয় করে আসছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন সমাজমাধ্যম ফেসবুকে পোস্টে জানান, ডা. জুবাইদা রহমান ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। আজ সকালের মধ্যেই তাঁর ঢাকায় পৌঁছানোর কথা, যাতে মমতাময়ী শাশুড়ির পাশে থেকে তাঁকে লন্ডন নিয়ে যেতে পারেন। পোস্টে আরও লেখেন, উন্নত ও সর্বাধুনিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ম্যাডামকে অতি শিগগির লন্ডনের হাসপাতালে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকদের অক্লান্ত পরিশ্রম, দেশবাসীর অনিঃশেষ দোয়া-আন্তরিকতা ও কূটনীতিকদের সহযোগিতায় তাঁর (খালেদা জিয়া) শারীরিক অগ্রগতি হয়েছে। দেশবাসীসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি দল ও জিয়া পরিবারের পক্ষে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে।