জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের সময়ের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এবার বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। তার বিরুদ্ধে গণ অভ্যুত্থানের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে হত্যাকাণ্ডে সহায়তার অভিযোগ আনা হয়েছে। গতকাল ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন কার্যালয়ের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য প্রসিকিউশনের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এক খুদে বার্তায় প্রসিকিউটর (এডমিন) গাজী এম এইচ তামীম জানান, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সজীব ওয়াজেদ জয়, জুনায়েদ আহমেদ পলক, সালমান এফ রহমান এবং আনিসুল হকের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়েছে প্রসিকিউশন। তবে অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি তিনি। এ বিষয়ে তাকে বারবার ফোন ও মেসেজ দিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
তবে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, এই চারজনের বিষয়ে দুটি পৃথক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হয়েছে। এর মধ্যে আন্দোলন চলাকালে ইন্টারনেট বন্ধ করে সংগঠিতভাবে হত্যাকাণ্ডে সহায়তা করার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে একটি মামলায়। এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে অন্য মামলায় আসামি করা হতে পারে। তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে প্রসিকিউশন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। সব ঠিক থাকলে আগামী সপ্তাহে এই দুই মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হতে পারে বলে জানিয়েছে সূত্রটি।
গুমের মামলায় হাসিনাসহ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানি শুরু : গুমের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ১০ সেনা কর্মকর্তাসহ ১৭ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি শুরু হয়েছে। গতকাল বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি অভিযোগ গঠনের আর্জি জানান। পরে আসামিপক্ষের শুনানির জন্য আগামী ১৪ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। একই দিনে আসামিদের অব্যাহতির আবেদনের শুনানি হবে বলেও ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছেন।
এদিকে গুমের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের এক মামলার আসামি ১০ সেনা কর্মকর্তাকে ভার্চুয়ালি হাজির করার আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। আদালতে আজ আসামিদের আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট ডক্টর তাবারক হোসেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। শুনানিতে সেনা কর্মকর্তাদের আইনজীবী ভার্চুয়াল হাজিরার পক্ষে নানা ধরনের যুক্তি তুলে ধরেন। তবে ট্রাইব্যুনাল বলেন, বিচার দেশের আইন অনুযায়ী হবে। সবাইকে কোর্টে আসতে হবে। আইন সবার জন্য সমান। ট্রাইব্যুনাল বলেন, সেনা বাহিনীর প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ সম্মান রয়েছে। আমরা এখানে অপরাধের বিচার করছি। কোনো বাহিনী বা বিভাগের নয়। দৃশ্যমান বিচারের স্বার্থে আপনাদের এই আবেদন গ্রহণ করা যায় না। তাই আবেদনটি খারিজ করে নিষ্পত্তি করা হলো।
অন্যদিকে শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে গুমের মতো ভয়ানক অপরাধকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছিল। গুমের ঘটনায় জীবিতদের মধ্যে ভাগ্যবান ছিল, দুই শ্রেণি। এর মধ্যে এক শ্রেণি, যাদের কোনো এক জায়গায় ফেলে দিয়ে পরে আবার পুলিশ দিয়ে আটক করে অস্ত্র মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হতো। আরেক শ্রেণি, যাদের ৫ থেকে ৭ বছর গুম করে রাখার পর কোনো এক নির্জন জায়গায় ফেলে দিয়ে যাওয়া হতো। তিনি বলেন, তবে যারা ভাগ্যবান ছিল না, তাদের সুন্দরবনের মতো গহিন বনে নিয়ে হত্যা করা হতো। তদন্ত প্রতিবেদনে এমন ভয়ানক চিত্রই উঠে এসেছে।
তিনি বলেন, স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে বলপূর্বক গুমের নজির সারা বিশ্বেই রয়েছে। বাংলাদেশে স্বৈরশাসন ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাথমিকভাবে শেখ মুজিবুর রহমান গুমের শুরু করেন। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা গুমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। তিনি বলেন, ডিজিএফআইয়ের জয়েন্ট ইন্টারগেশন সেলকে (জেআইসি) বলা হতো আয়নাঘর। অনেক সময় গোপন বন্দিশালাকে বলা হতো আর্টগ্যালারি। গুরুত্বপূর্ণ বন্দিদের ডাকা হতো মোনালিসা নামে। র্যাবের ট্রাসফোর্স ফর ইন্টারগেশন (টিএফআই) সেলের নামও ছিল আয়নাঘর। এর আরেক নাম ছিল ‘হাসপাতাল’। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, যারা এসব গুমের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের সরকার কর্তৃক অঘোষিত দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। ১৪ জনকে গুম করার ঘটনায় ১৭ আসামির বিরুদ্ধে চারটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়েছে বলে জানান চিফ প্রসিকিউটর।
এর আগে সকাল ১০টার পর ঢাকার সেনানিবাসের বিশেষ কারাগার থেকে বাংলাদেশ জেল-প্রিজন ভ্যান লেখা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সবুজ রঙের গাড়িতে করে গ্রেপ্তার ১০ সেনা কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ। তারা হলেন- র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, কর্নেল কে এম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (অবসরকালীন ছুটিতে), র্যাবের গোয়েন্দা শাখার সাবেক পরিচালক কর্নেল মো. মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম।
এই মামলার পলাতক আসামিরা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার প্রতিরক্ষাবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, র্যাবের সাবেক ডিজি এম খুরশিদ হোসেন, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশিদ ও র্যাবের সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মো. খায়রুল ইসলাম।
এর আগে, ২৩ নভেম্বর এ মামলার অভিযোগ গঠন নিয়ে শুনানির জন্য গতকালের দিন ধার্য করা হয়। তার আগে ২২ অক্টোবর সেনা হেফাজতে থাকা ১০ কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। সেদিন শুনানি শেষে তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১।